ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফেনী-১

দলীয় প্রার্থী চায় আওয়ামী লীগ দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিএনপি

ওছমান হারুন মাহমুদ, ফেনী

প্রকাশিত: ০০:১২, ২৪ আগস্ট ২০২৩

দলীয় প্রার্থী চায় আওয়ামী লীগ দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিএনপি

ফেনী নদীর নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে ফেনী

ফেনী নদীর নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে ফেনী। ১৮৭২-৭৪ সালের মধ্যে মোগল আমলের আমীরগাঁও থানা নদীভাঙনের মুখোমুখি হলে তা ফেনী নদীর ঘাটের অদূরে খাইয়অ্যারাতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। ওই থানাটি কোম্পানির কাগজপত্রে ফেনী থানা (ফেনী নদীর অদূরে বলে) নামে পরিচিত হয়। ১৮৭৬ সালে নতুন মহকুমার পত্তন হলে খাইয়অ্যারা থেকে থানা দপ্তরটি মহকুমা সদরে স্থানান্তর হয় এবং নতুন মহকুমাটি ফেনী নামে পরিচিত হয়। ফেনী জেলার তিনটি সংসদীয় আসনেই বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তিনটি আসনেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা চষে বেড়ালেও বিএনপির তৎপরতা তেমনটি নেই।

দলটি তাকিয়ে আছে নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের দিকে। মাঝে মধ্যে বিএনপির ২/১ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তাদের উপস্থিতির জানান দিলেও সার্বিকভাবে দলের কর্মকা-ে বিরাজ করছে নিষ্ক্রিয়ভাব।
পরশুরাম-ফুলগাজী-ছাগলনাইয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত ফেনী-১ সংসদীয় আসন। এই আসনের বর্তমান এমপি জাসদের (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে এই আসনটি ১৪ দলের অন্যতম শরিক জাসদকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। ফলে গত দুইবার নৌকা প্রতীক নিয়ে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শিরীন আখতার।
তবে আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এ আসন থেকে এবার দলীয় প্রার্থী চান আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এ বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বক্তব্য হচ্ছে, এই আসনে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের অবসান হয়েছে।  এখানে আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত, দলে কোনো গ্রুপিং বা কোন্দল নেই। তবে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে দলীয় নেতাকর্মীদের নিজেদের বলয়ে রাখার প্রতিযোগিতা আছে। ’৭৩ সালের পর এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী সংসদে যেতে পারেনি। তাই এবার এই আসনে দলের অস্তিত্ব রক্ষায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দলীয় মনোনয়নের দাবি জানিয়েছেন বলে জানান ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উল হায়দার চৌধুরী সোহেল। 
ছাগলনাইয়া উপজেলার একটি পৌরসভা, পাঁচটি ইউনিয়ন, ফুলগাজী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন ও পরশুরাম উপজেলার একটি পৌরসভা ও তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে ফেনী-১ আসন। এ আসনের ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ৮৬ হাজার ৪২৯ জন। ভোট কেন্দ্র রয়েছে ১০৩টি।
এই আসনটি ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি ফেনী-১ আসন থেকে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা সবাই ব্যক্তি ইমেজে বিজয়ী হয়েছেন। ’৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাংবাদিক এবিএম মুসা, ’৭৯ সালে বিএনপির প্রার্থী লে. কর্নেল (অব.) শেখ জাফর ইমাম বীর বিক্রম, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শেখ জাফর ইমাম। ’৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এই আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচিত হয়ে এই আসনটি ছেড়ে দেওয়ায় তার ছোট ভাই মেজর (অব) সাঈদ ইস্কান্দার এই আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। 
২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারি নির্বাচনে বিএনপি  অংশ না নেওয়ায় এবং আওয়ামী লীগ এই আসন মহাজোটকে ছেড়ে দেওয়ায় মহাজোটের প্রার্থী হিসাবে জাসদ (ইনু) প্রার্থী শিরীন আখতার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।  সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ১৪ দলের প্রার্থী হিসাবে এমপি নির্বাচিত হন জাসদের শিরীন আখতার।
ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সামছুদ্দিন ভুলু মজুমদার জানান, আগামী নির্বাচনে তারা দলীয় প্রার্থী চান। ’৭৩ সালের পর এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী জয়লাভ করতে পারেনি। ’৯১ সাল থেকে এই আসনে বিএনপির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। এখন সেই অবস্থা নেই। আওয়ামী লীগ এখানে সংগঠিত।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাবেক আমলা ও ’৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসারের দায়িত্ব পালনকারী আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী নাসিমের ফেনী জেলায় ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। গত ১৪ বছর ধরে তিনি আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় তার কিছু সমর্থক আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী নাসিমের পক্ষে মনোনয়ন তুলেছিলেন। এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে আলাউদ্দিন ফেনী-১ অথবা ফেনী-২ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী হতে পারেন।
এই আসন থেকে আবারও মনোনয়ন চাইবেন জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। এ প্রসঙ্গে শিরীন আখতার বলেন, সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট আবারও সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসবে। 
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, এই আসনে আওয়ামী লীগের অনেক যোগ্য ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন অনেক প্রার্থী আছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল জানান, আওয়ামী লীগ থেকে যদি  মনোনয়ন দেওয়া হয়, তা হলে বিএনপির কথিত ভোট ব্যাংক তছনছ হয়ে যাবে, আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হবে। তিনি বলেন, ফেনী-১ আসনের তিনটি উপজেলায় যে পরিমাণ ভোট আছে তার অর্ধেক ভোট ছাগলনাইয়া উপজেলায়। কয়েক যুগ ধরে ছৃাগলনাইয়া এলাকা থেকে দলীয় নেতারা সংসদ সদস্য হয়ে সংসদে যেতে পারেনি। তাই এবার দলের মনোনয়ন দেওয়া হোক এটা সবার দাবি।

আগামী নির্বাচনে এই আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন হাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল্লাহ। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে মাঠে ছিলেন। তবে নির্বাচনের তিনদিন আগে তিনি এলাকা ছেড়ে চলে যান। শেখ আবদুল্লাহ জানান, গত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী দেখবেন বলে আশ^াস দেওয়ায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলাম। এবার তিনি মনোনয়ন চাইবেন। ইতোমধ্যে তিনি এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছেন। তিনি মনোনয়ন পেলে জয়লাভ করবেন এমনটাই আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নির্বাচনের হাওয়া লাগায় নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মজুমদার। তিনি এলাকায় জনসংযোগ করে জনগণের কাছে পরিচিত হতে চেষ্টা করছেন। তিনি কৃষককে সার-বীজ দিয়ে এলাকায় পরিচিত হচ্ছেন। এ ছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব) শেখ জাফর ইমাম বীর বিক্রম আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে আলোচনায় উঠে এসেছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক  ইসমাইল হোসেন স¤্রাট এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন। সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে বের  হওয়ার পর তার গ্রামের বাড়ি পরশুরামে আসার দিন ফেনী থেকে পরশুরাম পর্যন্ত বর্ণাঢ্য শোডাউন করেছে। তারপর জেলা ও উপজেলার নেতাদের সঙ্গে পৃথকভাবে সৌজন্য সাক্ষাতও করেছেন। তার সমর্থকরা জানান, মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে জোর লবিং চলছে ইসমাইল হোসেন সম্রাটের পক্ষে।
এদিকে, এই আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু আদালত থেকে দণ্ডিত হওয়ায় তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারছেন না এটা নিশ্চিত। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়া কিংবা তার পরিবারের কেউ এই আসন থেকে প্রার্থী না হলে সেক্ষেত্রে ২০১৮ সালে এই আসনের বিএনপি দলীয় প্রার্থী ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) সদস্য সচিব রফিকুল আলম মঞ্জু আগামী নির্বাচনেও মনোনয়ন চাইবেন। 
এ বিষয়ে রফিকুল আলম মজনু বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বা তার পরিবারের কেউ এই আসনে নির্বাচন না করলে মনোনয়ন চাইব। তিনি গত পাঁচ বছর বেগম জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে এই আসনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তবে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত আসবে বিএনপি নির্বাচনে যাবে, কী যাবে না। 
এদিকে, জেলা জামায়াতের আমীর সামছুদ্দিন জানান, জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা থেকে ফেনী-১ আসনে দলের প্রার্থী হিসাবে কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য এসএম কামাল উদ্দিনের নাম দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে।  
এই আসনের জাতীয় পার্টি বা অন্য কোনো দলের শক্ত কোনো মনোনয়ন প্রত্যাশী এখন পর্যন্ত মাঠে নেই। ইসলামী আন্দোলন ফেনী শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা একরামুল হক জানান, আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি হিসাবে গত এক বছর যাবত জেলা উপজেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে।  ফেনী-১ আসনের জন্য  দলের  কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-দপ্তর সম্পাদক নুরুল করিম আকরাম ও জেলা ওলামা মাশায়েখের সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী গোলাম কিবরিয়ার নাম চূড়ান্ত করে রাখা হয়েছে। নির্বাচনের সময় আলোচনা করে একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হবে।

×