ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

ভাঙন প্লাবন ঝড় ॥ তবু বাঁধি ঘর

প্রকাশিত: ০১:১৬, ১৮ আগস্ট ২০২৩

ভাঙন প্লাবন ঝড় ॥ তবু বাঁধি ঘর

কুড়িগ্রামে ভাঙা গড়ার খেলায় নদীমাতৃক এলাকার মানুষের নতুন করে বসতি গড়ার প্রস্তুতি

প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেলা এই কুড়িগ্রাম। ১৬টি ভাঙ্গন প্রবন নদী এ জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। প্রকৃতির সাথে জীবন সংগ্রাম করেই এ অঞ্চলের মানুষ টিকে থাকে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ঘর বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়। জেলায় রয়েছে ৪শ ৫টি চর-দ্বীপ চর। এসব মানুষ ভাঙ্গা গড়ার সাথেই নিজের জীবনটাকে গড়েছে। সময় বদলিয়েছে সরকারও নদী ভাঙ্গন রোধে নানা পরিকল্পনা করেছে,নিচ্ছে ব্যবস্থাও। জেলা বাসীর দাবী ভাঙ্গন রোধে সরকার যেন মহা পারিক্লপনা নেয়। তাহলে রোধ হবে ভাঙ্গন। বদলে যাবে নদী ভাঙ্গা মানুষের জীবন মান।

চল্লিশ উর্দ্ধো মমতাজ বেগম স্বামী আর সন্তান নিয়ে রাতে খাওয়া দাওয়ার পর শুয়ে পড়েছিল। হঠাৎ নদীর ভাঙ্গনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বাড়ীর সামনে ধরলা নদী এসছে প্রবল ¯্রােতে ভাঙ্গছে আবাদী জমি আর ঘরবাড়ী। অল্প কিছুক্ষন পরেই তাদের বাড়ি ঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। অত রাতে ঘর সরানোর কোন অবস্থা নেই। তাদের করুন আত্মনাদে প্রতিবেশীরা এসে ঘরের ধান,কিছু আসবাব পত্র ও গরু ছাগল দ্রত সরিয়ে নিয়ে পাশ^র্বতী মানুষের জমিতে রেখেছিল। খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়ে আছে এখনও। মূহুর্তেই ঘরবাড়ী নদীতে ভেসে গিয়েছিল। সেদিনের বিভীষিকাময় রাতের  কথা ভুলতে পারে না মমতাজ বেগম। তার বাড়ী রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নে কিংসিনাই গ্রামে।সুখের সংসার ছিল তাদের।

ধরলা নদীর তীব্র ভাঙ্গনে নিঃস্ব অবস্থায় এখন পুরো পরিবার নিয়ে বাঁধের উপর  আশ্রয় নিয়ে আছে। ধরলা নদীর ভাঙ্গেনের এমন তীব্রতা  গত এক সপ্তাহে ঐ এলাকার আবদুর রহমান (৪০) ধরলা নদী তার বাড়ী ঘরা ভেঙ্গে নিয়েছে। এখন নদীর ধারে একটি ছাপড়া ঘরে পরিবারের সকল সদস্য নিয়ে বসবাস করছে। শুধু তিনি একা নন তার প্রতিবেশী মোসলেম উদ্দিন (৭০), জয়নাল উদ্দিন (৭৮) সকিনা বেগম সকলেই ঘর বাড়ী হারিয়ে কেউ বাঁধের উপর কেউ অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। 
কুড়িগ্রাম জেলা হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেলা একটি। এখানে ধরলা, তিস্তা, ব্রক্ষপুত্র,দুধকুমোর সহ প্রতিটি নদ-নদী ভাঙ্গন প্রবন। সারা বৎসর চলে ভাঙ্গন। বর্তমানে রাজোরহাট ও সদর উপজেলার কিং ছিনাই, একতা বাজার, সারডোব, জয়কুমোর,সাট কালুয়া, আরডি আর এস বাজার , গড়ের বাজার এলাকা ধরলা নদী তীব্র ভাংগছে। এই সব এলাকায় প্রায় দেড় হাজার পরিবার বাস করে। গত সাত দিনে রাজারহাটের কিং ছিনাই এলাকার প্রায় ৫০টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে নিস্ব হয়েছে। তারা বিভিন্ন বাঁধে,অন্যের জমিতে শুধু মাত্র পলিথিন অথবা ছাপড়া ঘরে আশ্রয় মানবেতর জীবন  যাপন করছে। গত তিন মাসে  প্রায় দেড়শ পরিবার ঘরবাড়ী হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। হোসেন আলী (৫২) জানান ১০ বছরে তিন থেকে চার বার বাড়ি ভেঙ্গেছি।

নতুন করে বাড়ি করতে দুই থেকে তিন লক্ষ টাকা লাগে। আমরা কৃষক মানুষ  কিভাবে চলবো। সন্তানদের পড়াশুনার খরচ চালাতে পারছি না। বন্ধ করে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত সরকারী কোন সাহায্য পাইনি। জীবন সংগ্রাম করে চলতে হয় প্রতি সময় আমাদের। একই ্এলাকার তোফাজ্জল হোসেন (৪৫) জানান আমি দুবার বাড়ি ভেঙ্গেছি। প্রথমবার বাড়ি ভেঙ্গে দেড় লাখ টাকা খরচ করেছিলাম । সে বাড়িও  ধরলা নদী ভেঙ্গেছে। এখন সকারের খাস জমিতে একটি ছাপড়া ঘরে কোন রকমে আছি স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে। জানিনা নতুন ঘরবাড়ি করতে পারবো কিনা। ভাঙ্গন কবলিত এলাকার গৃহবধু আমিনা বেগম (৩৫) ,খতিজন বেগম (৫৫) রহিমা বেগম (৩০) জানায় বর্তমান সময়ে চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। একদিকে বন্যা অন্যদিকে ভাঙ্গন।

তাদের গোছল ও বাথরুমের জায়গা পর্যন্ত নেই। আশে পাশের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যেতে হয় প্রাকৃতিক সাড়া দিতে। রান্না করার চরম কষ্ট হচ্ছে। রাস্তা ভাঙ্গনের জন্য চলাচল করতে পারছি না। ষ্াট উর্দ্ধ আব্দুর রহমান জানান কিং সিনাই গ্রামটি অনেক বড় ছিল। মাত্র তিন মাসের মধ্যে ৫ থেকে ৬ একর জমি বিলীন হয়ে গেছে ধরলার ভাঙ্গনে। ভাঙ্গন কবলিত পরিবারগুলি কেউ রাস্তার পাশে কেউ বাঁধে কেউ মানুষের জমিতে ছাপরা ঘর করে বসবাস করছে। এই গ্রামের সব মানুষ অনুরোধ করে সরকার যেন তাদের ভাঙ্গন রোধের ব্যবস্থা করেন। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মেম্বারদের প্রতি ক্ষোভ সাধারণ মানুষদের। তাদের এ বিপদে কেউ পাশে আশে না  এ অভিযোগ তাদের। এতো কষ্টের পরও তারা বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে ভবিষৎ।ছেলে মেয়ে নিয়ে বাচবে এটাই তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের জোরেই হয়তো তারা একদিন সুখের নাগাল পাবে।

ঝড়ঝঞ্ঝা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দারিদ্র্য জয়ে মডেল

জীবনযুদ্ধে তাঁরা জয়ী। পাল্টে দিয়েছেন সংসার-জীবন। একসময়ের কামলা-হাইলা, শ্রমজীবী শ্রেণির এই মানুষগুলো এখন পরিণত হয়েছেন মধ্যম শ্রেণির গেরস্ত পরিবারে। এখন আর ভাবতে হয় না সংসারের আর্থিক জোগান নিয়ে। কেটে গেছে জীবনের বিবর্ণ দশা। স্ত্রী-সন্তানের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। জীবনের ধূসর-বিবর্ণ রঙ বদলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এরা ছিল ইস্পাত কঠিন। হার না মানা লড়াইয়ে এসব সবুজ সেনানী শুধু নিজেরাই স্বাবলম্বী হয়নি, সৃষ্টি করেছেন অন্যেরও কর্মসংস্থান। একসময়ে এসব মানুষ নিজের কর্মসংস্থানে অন্যের বাড়িতে ঘুরতেন। আজ তারাই অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন।

অভাব তাড়ানোর লড়াইয়ে মানুষগুলো হয়ে আছেন সমাজের জীবন্ত দৃষ্টান্ত। কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক পরিবার এমন লড়াই করে পাল্টে দিয়েছেন নিজেদের জীবন। পুরো বছর শাক-সবজি কিংবা রবিশস্যসহ উফশী জাতের ধানের আবাদ করে তারা তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। 
বাড়ির আঙিনা থেকে পুকুর কিংবা এক চিলতে জমি সবকিছুই ১২মাস পরিপূর্ণ থাকছে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজিতে। গ্রীষ্ম, শীত কিংবা বর্ষা কখনই কাউকে বসে থাকতে হয় না। যেন একেকজন দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলের বাস্তবায়ন নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকছেন।

সিডর, আইলাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবিলা করে এসব উদ্যমী মানুষগুলো জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে সফল। নীলগঞ্জ ইউনিয়নের এই চাষীরা এখন সাগরপারের এ জনপদের অহংকারে পরিণত হয়েছেন। হয়েছেন এরা সবাই উৎপাদক শ্রেণির মানুষ। এদের সঙ্গে কথা না বললে বোঝার উপায় নেই যে, কিভাবে নিজ উদ্যোগে জীবন কিংবা সংসার থেকে দূর করেছেন অভাব।
কলাপাড়া-কুয়াকাটা সড়কের আন্ধার মানিক নদীর ফেরি পার হলেই নীলগঞ্জ ইউনিয়ন। কুয়াকাটা পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার মহাসড়কের প্রায় ১৩ কিমি চলে গেছে এই ইউনিয়নের মাঝখান দিয়ে। ইউনিয়নকে বিভক্ত করেছে মহাসড়কটি। এই সড়কের পূর্বদিকের গ্রামগুলোয় অধিকাংশ সবজি চাষির বসবাস, খেত-খামার। বিশেষ করে কুমিরমারা, এলেমপুর, মজিদপুর, গামুরিতলা, নেয়ামতপুর, ফরিদগঞ্জ, আমিরাবাদ, পাখিমারাসহ আশপাশের গ্রামগুলোয় ঘুরলে চোখ জুড়িয়ে যায় তাদের সফলতা দেখে। মাঠের মধ্যে শেড দেওয়া বহু সবজির খেত।

দুঃখ যেন এদেরকে ভয় পায়, থাকে দূরে। আর অভাব যেন পালিয়ে গেছে এদের হার না মানা জীবন যুদ্ধে। প্রত্যেক কৃষকের বাড়ির উঠোন থেকে পুকুরপাড় কিংবা বাড়ির আশপাশের এক চিলতে জমি পর্যন্ত সবজির আবাদে পরিপূর্ণ। এলাকার মাঠজুড়ে রয়েছে সবুজের আচ্ছাদন। ঝড়-ঝঞ্জা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতির পরও আবার দ্রুত খেত তৈরির কাজে নেমে পড়েন। 
চার সন্তানের জনক সুলতান গাজীর বাড়ি কুমিরমারা গ্রামে। জানালেন, সংসারে এক সময় নুন আনতে পানতা ফুড়াতো। প্রায় এক যুগ ধরে এই মানুষটি জীবনযুদ্ধের লড়াই করে সফলতার ছোয়া পেয়েছেন। তার বাবা আবদুল আজিজ গাজীর হাত ধরে সবজির আবাদে নেমেছিলেন। আজিজ গাজী গোটা কুমিরমারা গ্রামে সবজি আবাদের রূপকার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। গোড়াপত্তন করেছিলেন। এক যুগেরও আগে ইহলোক ছেড়ে গেছেন সবজি চাষের গোড়াপত্তনকারী মানুষটি। কিন্তু গ্রামটির শতকরা ৯০ জন কৃষক সবজি আবাদের মধ্য দিয়ে এখনো তার চেহারা দেখতে পায়। এক সময়ে যশোর খুলনা অঞ্চল থেকে হাইব্রিড জাতের বিভিন্ন সবজির বীজ এনে এই এলাকায় চাষাবাদ শুরু করেছেন প্রয়াত আজিজ গাজী। 
তিনি আরও  জানালেন, জীবনে বহু অভাবের দিন পার করেছেন। অন্তত ১৫ বছর আগের কথা, নিজেদের কাজ ছিল না। উপার্জন ছিল না। অন্যের কামলা জোটাতেও পারতেন না। কিন্তু আজ তার গেরস্ত পরিবার। চার সন্তানের তিন জনকে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন। স্ত্রীসহ ১২জনের সংসারে অনাবিল সুখ-শান্তি বিরাজমান। সন্তানরা উচ্চশিক্ষা নিলেও এখন কৃষিতে সফল। চাকরির দৌড়ে নামেননি। জানালেন, জমিতে লাউ, বরবটি, করলা, বেগুন, মরিচের আবাদ করেছেন বরাবরের মতো। তবে এ বছর ফলন খুবই ভালো। পুরো মৌসুমজুড়ে দামও ভালো পেয়েছেন।

গড়ে মাসে অন্তত ১২-১৫ হাজার টাকা লাভ হয় এই সফল সবজি চাষির। গাজীর দাবি, এই এলাকায় বেশি জমির দরকার নেই। প্রত্যেক পরিবার দুই থেকে চার বিঘা জমি তিন ফসলের আওতায় আনতে পারলেই সারা বছরের খোরাকি ছাড়াও অনেক লাভ করা সম্ভব। তার ভাষ্যমতে, ‘নিজের থেইক্যা ইচ্ছা থাকলে অভাব থাহে না’। এই পরিবারটিতে এখন সুখের ছোয়া বইছে। সবচেয়ে সাফল্যের খবরটি হচ্ছে এসব পরিবারের কেউ কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থার থেকে একটি টাকাও লোন নেয়নি। যেন সাফল্যের ষোলোকলায় পূর্ণ এসব পরিবার। 
আরেক সফল চাষি জাকীর গাজী। আধুনিক মালচিং ও শেড পদ্ধতির চাষাবাদে তার জুড়ি নেই। নিত্য-নতুন কৌশলে রপ্ত মানুষটি।

হাসি-খুশি থাকা মানুষটির খেত ভরা থাকে কোনো না কোনো সবজির ফলনে। জানালেন, একসময় নির্মাণ শ্রমিক ছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় জীবনের সব এলোমেলো হয়ে যায়। বেকার হয়ে বাড়িতে নিঃস্ব হয়েছিলেন। জানালেন, মাত্র দশ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে ২০১৪ সালে কৃষিকাজ শুরু করেন। করেন আধুনিক পদ্ধতির সবজির আবাদ। এখন সফল এই চাষি। পরিপূর্ণ গেরস্ত পরিবার। বছরে গড়ে দুই-আড়াই লাখ টাকার সবজি বিক্রি করেন। সকল কৃষকের বান্ধব হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। বলতে গেলে উদ্ভাবক শ্রেণির এক উদ্যমী কৃষক। নতুন নতুন জাতের সবজি এবং নতুন নতুন পদ্ধতির (গ্রিন হাউস) আবাদে ঝুঁকছেন এই মানুষটি।

জাকির গাজী জানালেন, সরকারি উদ্যোগে তাদের গ্রামে বিএডিসির উদ্যোগে খাল খনন করে দেওয়ায় তারা চাষাবাদে বেশি সফলতা পেয়েছেন। বিরামহীন বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় এ কৃষকের ক্ষতি অনেক কম হয়েছে বলে জানালেন। মাটি কেটে উঁচু জমিতে শেড পদ্ধতির কারণে বৃষ্টির পানি জমতে পারেনি। আর মালচিং পদ্ধতির কারণে গাছের গোড়ার মাটির ক্ষয় কম হয়েছে। লতা জাতীয় সব সবজি নষ্ট হলেও কাঁচা এবং বোম্বাই মরিচ নষ্ট হয়নি। জলাবদ্ধতার ধকল কাটিয়ে ফের বেগুন, লালশাক, পালংশাক আবাদের প্রস্তুতির কথা জানালেন তিনি। স্ত্রী শাহিদা বেগমসহ চার সন্তান নিয়ে জাকির গাজী এখন রয়েছেন আর্থিক স্বস্তিতে।

শুধু কৃষিকাজ নয়, হাস-মুরগি, গবাদিপশু পালন করছেন। পুকুরে মাছ চাষ করছেন। সন্তানদের করাচ্ছেন লেখাপড়া। জাকিরের দাবি বৃষ্টির ক্ষতির আগে তাদের কুমিরমারার একটি গ্রাম থেকে প্রতিদিন অন্তত ৫-৭ টন করলা, বরবটি, মরিচ স্থানীয় পাখিমারা বাজারে পাইকারি বিক্রি করেছেন। তবে পাখিমারা খালের মিঠাপানি সারা বছর সংরক্ষণে খালটির ব্যবস্থাপনা প্রকৃত কৃষকের হাতে থাকা খুবই জরুরি প্রয়োজন। আর স্লুইসের ভাঙ্গা গেট জরুরিভাবে মেরামত করা দরকার। এক কথায় মিঠা পানির ব্যবস্থা আর কৃষিপণ্য আনা-নেয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলেই কৃষকের আর কিছু দরকার হয় না।
এলেমপুর গ্রামের আরেক সফল চাষি আলী আহম্মদ। জানালেন, প্রায় ২০ বছর আগে নিজের বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে কুয়াকাটাগামী মহাসড়কের পাশে ছলিমপুর গ্রামে অন্যের চার বিঘা জমি বন্ধকী রেখেছেন। প্রতি বছর যে পরিমাণ ধান হতো ওই পরিমাণ মূল্য ১২-১৪ হাজার টাকা দিতে হয় জমির মালিককে। প্রথম বছরে জমির চারদিকে এবং ভিতরে লম্বালম্বি লেক করেছেন। তার চারদিকে উঁচু করে মাটি ভরাট করেছেন, যাতে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়। এছাড়া সংলগ্ন খালে লোনা পানি থাকায় শুকনো মৌসুমে সেচের জন্য প্লটের ভিতরের লেকে মিঠা পানি সংগ্রহ করেন।

প্রথম বছরে জমি তৈরি, লেবার মজুরি, জাল দিয়ে মাচান করা, বীজ-সার-ওষুধ নিয়ে মোট দেড় লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। করলা, মরিচ, বরবটি, পুইশাক, লাউ, ঝিঙের আবাদ করেছেন। প্রায় আড়াই লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। পরের বছর খরচ হয় মাত্র ১০ হাজার টাকা। বিক্রি হয় এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা। এখন কৃষিতে তিনি সফল। একসময় আলী আহম্মেদ অন্যের বাড়িতে বদলা-কামলা দিতেন। আজ আর তাকে অর্থের জন্য ভাবতে হয় না। প্রতিদিন সকালে ভ্যান কিংবা টমটম বোঝাই দিয়ে নিজের উৎপাদিত লাউ, করলা, কাঁচা মরিচ, শসা, কুমড়া, লাউ, বরবটি বিক্রির জন্য কলাপাড়া পৌর শহরে নিয়ে আসেন। বিক্রি শেষে কড়কড়ে নোট নিয়ে বাড়িতে ফেরেন। 
একই অবস্থা মজিদপুরের নেছারুদ্দিন, জাকির মুসুল্লি, এলেমপুরের বয়েজিদ, আবদুল খালেক, কুমিরমারার আবুল কালামসহ অধিকাংশের। এভাবে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক কৃষক পরিবার সবজি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এলাকার দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতা পেয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এআরএম সাইফুল্লাহ জানান, কলাপাড়ায় মোট ৩৯ হাজার কৃষক পরিবার রয়েছে। এ তথ্য পাঁচ বছর আগের। এখন ফি-বছর শতকরা পাঁচ ভাগ কমছে। তবে কৃষকরা এখনো এখানকার ধানের উদ্ধৃত্ত উৎপাদন ধরে রেখেছেন। তারা উফশী জাতের ধানের আবাদ করছেন। আর হাইব্রিড জাতের সবজির দিকে ঝুঁকছেন প্রতিনিয়ত। তার দাবি, কলাপাড়ায় অন্তত দেড় হাজার চাষী বাণিজ্যিকভাবে সবজির আবাদ করছেন। এর মধ্যে নীলগঞ্জের চাষিরা সবচেয়ে এগিয়ে। তারা খুবই উদ্যমী। পরিশ্রমী। এরা আধুনিকভাবে শেড এবং মালচিং পদ্ধতিতে সবজির আবাদ করায় তাদের ঝড়-বৃষ্টিতে ঝুঁকি অনেকটা কম রয়েছে।

×