ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

কবিরাজি ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন আব্দুল হামিদ

-

প্রকাশিত: ০১:০১, ২১ জুলাই ২০২৩

কবিরাজি ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন আব্দুল হামিদ

আব্দুল হামিদ

চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসারের আগে কবিরাজি চিকিৎসাই ছিল রোগবালাই থেকে মুক্তির উপায়। দুই ধরনের কবিরাজ ছিল গ্রামাঞ্চলে। একদল ঝাড়ফুঁকের চিকিৎসা করতেন, আরেক দল ছিলেন যারা গাছপালা বা লতাপাতার তৈরি (হারবাল) ওষুধ বিক্রি করতেন। ঝাড়ফুঁক চিকিৎসা কখনো বিজ্ঞানের সমর্থন পায়নি। কিন্তু গাছগাছড়ার চিকিৎসা দিনে দিনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তাই কবিরাজের বাক্স থেকে বেরিয়ে তা এখন স্থান পাচ্ছে অ্যালোপ্যাথিক ফার্মেসিতেও। আধুনিককালের চিকিৎসকরাও লিখছেন হারবাল ওষুধের প্রেসক্রিপশন। এসব ওষুধের প্রতি বেশ আস্থাও আছে সাধারণ মানুষের। গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু কিছু কবিরাজ এখনো কবিরাজি চিকিৎসার সেই সনাতন ধারাটি ধরে রেখেছেন। তাদেরই একজন নেত্রকোনার আব্দুল হামিদ।

ঔষধি গাছ সংগ্রহ ও চাষ এবং নিজ হাতে তৈরি করা ওষুধ বিক্রিই ষাটোর্ধ এ ব্যক্তির পেশা এবং নেশা। দুর্লভ গাছগাছালি সংগ্রহ এবং চাষাবাদের কারণে অনেকে তাকে চেনেন ‘বৃক্ষপ্রেমিক আব্দুল হামিদ’ নামে। জেলা সদরের সার্কিট হাউস মোড়ে ‘এলিফা ঔষধি দোকান’ নামে একটি হারবাল ওষুধের দোকান পরিচালনা করেন তিনি। কেন্দুয়া উপজেলার দলপা-রামপুরে জন্ম নেওয়া আব্দুল হামিদ জানান, তিনি যখন কিশোর, তখন তার মা ও এক ছোট বোন জটিল অসুখে মারা যান। তাদের চিকিৎসা করেছিলেন নন্দীগ্রামের জগদীশ কবিরাজ। জগদীশের সান্নিধ্যে এসে তিনি ঔষধি গাছের গুণাগুণ সম্পর্কে জানতে পারেন। এরপর প্রথমে নিজ গ্রামের এক ব্যক্তির পরিত্যক্ত ভিটায় গড়ে তুলেন প্রায় দেড়শ’ প্রজাতির ঔষধি গাছের বাগান।

২০০২ সালে মাত্র দেড়শ’ টাকা পুঁজি নিয়ে নেত্রকোনা শহরে এসে অ্যালোভেরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি গাছের শরবত বেচতে শুরু করেন। আস্তে আস্তে তার শরবতের চাহিদা বাড়তে থাকে। চাহিদা পূরণ করতে বিভিন্ন সরকারি অফিসের পরিত্যক্ত জায়গায় অ্যালোভেরা, তুলসী, নিশিন্দা, বহেরা, অর্জুন, আমলকি, হরিতকিসহ নানা প্রজাতির ঔষধি গাছ চাষ করতে শুরু করেন তিনি। এভাবে চলতে চলতে ২০১২ সালে শহরের হাসপাতাল রোডের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে ‘এলিফা ঔষধি দোকান’ নামে ভেষজ ওষুধের দোকান দেন। দোকানটিতে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেচা হয়। এ আয় দিয়েই চলে সংসার। বেশিরভাগ সময় তার দুই ছেলে সোহেল ও হাবেল দোকানটি পরিচালনা করেন। আর তিনি ব্যস্ত থাকেন গাছের পরিচর্যা ও ওষুধ তৈরির কাজে। বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার অ্যালোভেরা ও অন্যান্য প্রজাতির গাছ আছে তার বাগানে। 
আব্দুল হামিদ জানান, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ৩০ হাজার অ্যালোভেরাসহ অন্যান্য ঔষধি গাছ বিতরণ করেছেন। উন্নয়ন সংগঠন ‘বারসিক’-এর কর্মকর্তা অহিদুর রহমান জানান, ‘এখানকার মানুষদের অ্যালোভেরা গাছ ও এর গুণাগুণ সম্পর্কে তিনিই প্রথম পরিচয় করে দিয়েছেন।’ 
আগে আব্দুল হামিদকে নিজ খরচেই সবকিছু করতে হতো। এখন মাঝেমধ্যে কেউ কেউ তাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন। নেত্রকোনার সাবেক জেলা প্রশাসক কাজী আবদুর রহমান একবার তাকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেন। নেত্রকোনা মডেল থানার সাবেক ওসি তাজুল ইসলাম ১৬ হাজার টাকা ব্যয়ে কিনে দেন একটি ভ্যানগাড়ি। ‘রক্তদানে নেত্রকোনা’ নামে একটি সংগঠন তার পুরনো বাইসাইকেলটি মেরামত করে দেয়। ‘বারসিক’ নামে একটি এনজিও প্রচার-কাজের জন্য কিনে দেয় একটি হ্যান্ডমাইক। শহরের বলাইনগুয়ার বাসিন্দা পল্লব চক্রবর্তী বলেন, ‘মানুষের দেওয়া টাকা কখনো নিজের জন্য ব্যয় করেন না তিনি। নিজে না খেয়েও বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান।’

একটি আক্ষেপ আছে আব্দুল হামিদের। তার নিজের কোনো জায়গাজমি নেই। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের পরিত্যক্ত বাড়ির ছাদে ঔষধি গাছের চাষ করেন তিনি। স্থায়ীভাবে একটি খালি জমি বরাদ্দ পেলে সেখানে একটি বড় আকারের ঔষধি গাছের বাগান করার স্বপ্ন আছে তার। তিনি নিজেও জানেন না সে স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে কি-না ।

×