
পঞ্চগড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদ শিক্ষাবৃত্তির চেক তুলে দেওয়া হচ্ছে এক শিক্ষার্থীর হাতে
নক্ষত্রের আলোকবর্তিকা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান আধুনিক সংবাদপত্রের প্রবক্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ১১টায় গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের আয়োজনে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক অফিস সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিদরিদ্র, অসচ্ছল ও মেধাবী ১৫ জন শিক্ষার্থীর হাতে দ্বিতীয়বারের শিক্ষাবৃত্তির চেক তুলে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষার্থীদের হাতে চেক তুলে দেন স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক আজাদ জাহান (উপসচিব)।
দৈনিক জনকণ্ঠের ‘শিক্ষা সাগর’ পাতার কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর মো. ইকরামুল হকের সভাপতিত্বে ও দৈনিক জনকণ্ঠের পঞ্চগড়ের স্টাফ রিপোর্টার এ রহমান মুকুলের সঞ্চালনায় শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পঞ্চগড় সরকারি মকবুলার রহমান কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর দেলওয়ার হোসেন প্রধান, জেলা শিক্ষা অফিসার শাহীন আকতার, পঞ্চগড় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সফিকুল আলম, সাধারণ সম্পাদক জামিল চৌধুরী ডলার, সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম শহীদ, আমীর খসরু লাবলু, লুৎফর রহমান, হারুন অর রশিদ হারুন প্রমুখ।
মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় আমার কর্মজীবী মার একটি হাত হারিয়ে সংসারের টানাপোড়েনে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম ছিল। লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলেও মায়ের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল আমার পরিবার। ঠিক সেই মুহূর্তে বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হওয়ায় আমি ও আমার পরিবার গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। এখন আর আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে না। এই বৃত্তির অর্থ দিয়ে আমি সুন্দরভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারব। শিক্ষাবৃত্তির চেক হাতে নিয়ে কথাগুলো বলছিল পঞ্চগড় সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী আনুশকা জাহান।
দেবীগঞ্জ অলদিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাইরুজ ইয়াসমিন বলেন, লেখাপড়ার খরচের জন্য অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে যাচ্ছে। অনেকে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। এই শিক্ষাবৃত্তি কেবল আমাদের লেখাপড়ায় সহায়তা করবে না বরং এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাবে।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার টেংগনমারি এলাকার অভিভাবক শরিফুল ইসলাম বলেন, আমি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করি। এই শিক্ষাবৃত্তি পাওয়াতে আমার অনেক উপকার হয়েছে। আমার মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো আমার জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। এখন কিছুটা সহজ হলো।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আজাদ জাহান বলেন, মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদ এই শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন মানুষের মাঝে। এই শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আলোকিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কেবল জিপিএ-৫ পাওয়া নয় মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। তিনি বলেন, পশ্চাৎপদ জেলা পঞ্চগড়কে এই শিক্ষাবৃত্তির আওতায় নিয়ে আসায় জনকণ্ঠ সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। জনকণ্ঠের মতো দেশের বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ এবং সমাজের বিভিন্ন সংগঠন যদি এভাবে এগিয়ে আসেন তাহলে আমরা অচিরেই বাংলাদেশকে অনেক উন্নত দেশের কাতারে দেখতে পারব।
১৯৯৭ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ দেশের পাঁচটি জায়গা থেকে বের হওয়া শুরু করল। তখন দেশের সকল জেলায় প্রতিদিন সকালেই জনকণ্ঠ পাওয়া যেত। ঢাকা থেকে প্রকাশিত আর অন্যসব পত্রিকা একদিন পর পাওয়া যেত।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর দেলওয়ার হোসেন প্রধান বলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকার অনেক প্রণোদনা দিচ্ছে। তার পাশাপাশি কিছু গুণী মানুষ শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছে। তাদের মধ্যে জনকণ্ঠ পরিবার অন্যতম। এই শিক্ষাবৃত্তির টাকা দরিদ্র পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শিক্ষার্থীদের উচিত জন্ম যেখানেই হোক না কেন নিজেকে যোগ্য ও মেধাবী করে প্রতিষ্ঠিত করা। এ সময় তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা জনকণ্ঠ প্রতিষ্ঠাতা আতিকউল্লাহ খান মাসুদের আত্মার শান্তি কামনা করেন।
জেলা শিক্ষা অফিসার শাহীন আকতার বলেন, আমি শ্রদ্ধা জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের প্রতি। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জন্য কাজ করে গেছেন। এখন এই বৃত্তির উদ্দেশ্য কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আশা করি আগামীতে বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। জনকণ্ঠের এমন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
দৈনিক জনকণ্ঠের ‘শিক্ষা সাগর’ পাতার কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর মো. ইকরামুল হক বলেন, আমরা চাই এই শিক্ষা বৃত্তি দিয়ে যেন একজন শিক্ষার্থী খাতা, কলম কিনে লেখাপড়া সহজে করতে পারে।
আমাদের জনকণ্ঠের এই প্রচেষ্টা যদি একজন শিক্ষার্থীর কাজে লাগে তাহলে আমরা মনে করব আমাদের এই প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দুটি শর্ত। বৃত্তি পাওয়া কোনো মেয়ের যদি বিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তার বৃত্তি বাতিল হবে। আর কেউ পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও তার বৃত্তি বাতিল হবে। আমরা চাই আমাদের সহযোগিতা নিয়ে তারা পড়াশোনা করে এগিয়ে যাক।
পঞ্চগড় জেলায় শিক্ষাবৃত্তি পেল যারা ॥ পঞ্চগড় পৌরসভায় পঞ্চগড় সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মোছা. তাহমিনা আক্তার, মোছা. আনুশকা জাহান, হাজি ছফির উদ্দিন গার্লস স্কুলের সানিয়া ইসলাম জিতু, সদর উপজেলার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার কলেজিয়েটের মো. লায়ন আলী, বোদা উপজেলার পাথরাজ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের জয় নারায়ণ, পাঁচপীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বৃষ্টি রাণী, আমতলা কাজীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের বিশাখা রাণী বর্না, আটোয়ারী উপজেলার বড়দাপ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের পূজা রাণী সেন, দলুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মোছা. খাদিজা বেগম, দেবীগঞ্জ উপজেলার বিনয়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সৌরভ চন্দ্র রায়, নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শাহরিয়ার রহমান, দেবীগঞ্জ অলদিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ফাইরুজ ইয়াছমিন, তেঁতুলিয়া উপজেলার শালবাহান দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের উমাইয়া আতিন অপু, রনচন্ডি উচ্চ বিদ্যালয়ের উম্মে ফারিহা উর্মি, নাওয়াপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএম জুলিয়ান মোর্শেদ জামিল।
শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে গত বছর শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া ১৫ জন শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক, এ বছরের ১৫ জন শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর অভিভাবক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তারা গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের এমন মহতী উদ্যোগের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
দৈনিক জনকণ্ঠের ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চেয়ারম্যান, সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর শামীমা এ খান গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ও দৈনিক জনকণ্ঠের সাবেক সম্পাদক প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের স্মরণে এই শিক্ষাবৃত্তি চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর গত বছর থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে পঞ্চগড়, নাটোর, রাজশাহী ও গাইবান্ধা জেলায় শিক্ষাবৃত্তি চালু হয়। এই বৃত্তির আওতায় প্রতিমাসে শিক্ষার্থীদের দেড় হাজার টাকা করে প্রদান করা হচ্ছে। সুবিধাভোগী একই শিক্ষার্থী নবম ও দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন দুই বছর এই শিক্ষাবৃত্তি পাচ্ছে। চলতি বছর দশম শ্রেণির ১৫ শিক্ষার্থী এর আওতাভুক্ত হয়েছে। শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা নিয়মিত লেখাপড়া করছে কি না সেটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হবে।