
তালমা নদীর বুকে এখন করা হচ্ছে ধান চাষ
এক সময়ের প্রমত্ত করতোয়া এখন ধু ধু বালুচর। শত কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্খননের দু’বছর না গড়াতেই আগের রূপে ফিরেছে এ জেলার প্রধান নদী করতোয়া। হাঁটুজলের এই নদীর বালুচরের বেশিরভাগ জায়গাজুড়ে হয়েছে বোরো ধানের চাষ। শুধু করতোয়াই নয়, জেলার ছোট-বড় ৩৩টি নদীর মধ্যে সাতটি নদী পুনর্খনন করা হলেও প্রায় সব নদীই ফিরতে শুরু করেছে আগের চেহারায়। সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এসব নদী পুনর্খনন না করায় এবং উজান থেকে প্রতিনিয়ত বালু বয়ে আসায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন নদী তীরবর্তী স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশবিদরা।
করতোয়া, তালমা, ডাহুক, ভেরসা, বুড়ি তিস্তা, তীরনই, রণচণ্ডি, টাঙ্গন, কুড়ুম, চাওয়াই, গোবরা, পাথরাজসহ জেলার সবকটি নদ-নদী এখন প্রায় পানিশূন্য। এসব নদীর বুক চিরে সোনালি ধানখেত। আর এসব ধানখেতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ধ্বংসের পথে জীববৈচিত্র্য ও মাছসহ জলজ প্রাণী। পানি উন্নয়ন বোর্ড পঞ্চগড় অফিস সূত্র জানায়, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলার সাতটি নদী ও একটি খালের মোট ১৭৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পুনর্খনন করা হয়েছে। যাতে মোট ব্যয় হয়েছে ১০৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
এর মধ্যে জেলার প্রধান নদী করতোয়া পঞ্চগড়ের মীরগড় থেকে দিনাজপুরের খানাসামা পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার পুনর্খনন করা হয়েছে। এ ছাড়াও জেলার অভ্যন্তরের পাথরাজ নদী ২০ কিলোমিটার, বুড়ি তিস্তা নদী ২০ কিলোমিটার, চাওয়াই নদী ২০ কিলোমিটার, ভেরসা নদী ১০ কিলোমিটার, তিরনই নদী সাত দশমিক ছয় কিলোমিটার এবং রসেয়া নদী ছয় দশমিক নয় কিলোমিটার পুনর্খনন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জেলার বড়সিঙ্গীয়া খাল ছয় কিলোমিটার পুনর্খনন করা হয়েছে। পঞ্চগড় শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীতে গিয়ে দেখা যায়, ২০২১ সালের পুনর্খনন করা করতোয়া নদীর বেশিরভাগ স্থানে এবার বোরো ধানের চাষ হয়েছে।
পুনর্খননের সময় নদীর দুই ধারে জমিয়ে রাখা বালু বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে আবারও নদীতে গিয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে উজান থেকে পানির সঙ্গে বয়ে আসা বালুতে নদীর বেশিরভাগ জায়গা ভরাট হয়ে বালুচরে পরিণত হয়েছে। যে অংশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে সেটিও সরু খাল, হাঁটুজল। এমনই চিত্র দেখা গেছে জেলার বোদা উপজেলার মাড়েয়া-বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায়। করতোয়া নদীর এই আউলিয়ার ঘাটে ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নৌকাডুবিতে ৭২ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। সেখানেই এখন পানি কমে গিয়ে দুই ধারে হয়েছে ধানের আবাদ। এ ছাড়াও জেলার বোদা উপজেলার কালিয়াগঞ্জ এলাকার করতোয়া নদীতেও হয়েছে বোরো ধানের চাষ। স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, নদী খননের বছর পানি বেশি থাকায় ধান চাষ করা যায়নি। তবে এর পর নদী আগের মতো হয়ে যাওয়ায় এখন ধান চাষ করা যাচ্ছে।
করতোয়া নদীপাড়ের বাসিন্দারা বলেন, নদী খনন করে কোনো লাভ হয়নি। খননের সময় গভীরতা কম দেওয়া হয়েছিল। তাড়াহুড়া করে বিল নেওয়ার জন্য দায়সারা কাজ হয়েছিল। যেমন নদী ছিল, এখন আবারও তেমনি হয়ে গেছে। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন আশপাশের সবাই নদীতে ধানের চাষ করছেন।
পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং প্রকৃতি ও জীবন ক্লাবের উপদেষ্টা তোহিদুল বারী বাবু বলেন, পঞ্চগড়ের নদ-নদীগুলোর পুনর্খনন কাজ সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী না করায় পুনর্খননের এক বছরের মধ্যে পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে। পুনর্খননের সময় নদীর বালুগুলো ধারেই রেখে দেওয়ায় আবার সেই বালু নদীতে গিয়ে ভরাট হয়েছে। উজান থেকে হাজার হাজার টন পলি ও বালু ভেসে এসে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশুতোষ বর্মণ বলেন, পঞ্চগড়ের নদীগুলো প্রায় সবই ভারত থেকে এসেছে। হিমালয়ঘেঁষা এসব নদীতে প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণে বালু বয়ে আসে। এসব কারণেই হয়তো এমনটা হতে পারে। তবে পঞ্চগড়ের ৩৩টি নদীকেই টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের স্ট্যাডি চলছে। এ ছাড়া পঞ্চগড়ের নদীগুলো ভাঙনরোধে কার্যরক্রম গ্রহণ করাসহ আরও কয়েকটি নদী ও খাল খননের বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।
গোবিন্দগঞ্জে প্রমত্ত করতোয়া এখন পানিশূন্য
সংবাদদাতা গোবিন্দগঞ্জ গাইবান্ধা থেকে জানান, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বুক চিরে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী এখন পানিশূন্য। এ কারণে নৌকা বা সাঁকোতে নয়, হেঁটেই পারাপার হচ্ছেন এলাকাবাসী। কোথাও কোথাও আবার গবাদিপশুর চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে নদীর বুক। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় নদীর বুকজুড়ে এখন শুধুই বালুচর। প্রমত্তা করতোয়ার এই দুরবস্থায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকসহ নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষ। এই নদীকে ঘিরে সৃষ্টি করেছে দুটি শহরসহ কয়েকটি বন্দর ও গঞ্জ। এক সময় এই নদীর বুকে ভর করে চলাচল করত বড় বড় বজরা নৌকা। কালের আবর্তে সব বন্ধ হয়ে গেছে। এখন নদীর অস্তিত্বই হুমকির মুখে।
নদীপাড়ের লোকজন জানান, নদীতে পানি না থাকায় দু’পাড়ের মানুষ এখন হেঁটেই নদী পেরিয়ে চলাচল করছেন। আবার অনেকেই পার হন মোটরসাইকেল অথবা অন্য কোন যানবাহনে চড়ে। নদীর বুকেই চাষ হচ্ছে ধানসহ নানা ধরনের ফসল। কোথাও কোথাও গরু-ছাগলের চারণভূমিতেও পরিণত হয়েছে। দরবস্ত ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের হযরত আলী বলেন, আগে নদীর পানিতে গোসল করতাম, গরু-বাছুরকে গোসল করাতাম, এখন সে অবস্থা শুধুই স্মৃতি। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ প্রধান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্পে নদীর নাব্য ফেরাতে করতোয়া নদীর পূর্ব পাশে বাঙালি নদী খনন কাজ শুরু করেছেন।