ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

বিস্ফোরক দিয়ে বিরলী ব্রিজ উড়িয়ে দেই

ওছমান হারুন মাহমুদ, ফেনী

প্রকাশিত: ০০:২৪, ৫ জানুয়ারি ২০২৩

বিস্ফোরক দিয়ে বিরলী ব্রিজ উড়িয়ে দেই

আবদুল মোতালেব

ফেনী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেকের ছেলে আবদুল মোতালেব। মোতালেব তখন ফেনী কলেজের এইচএসসি প্রথমবর্ষের ছাত্র। রাজনৈতিক সচেতন পরিবারের সন্তান হিসেবে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ কর করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘৭১-এর ২৬ মার্চ ফেনী সিও অফিসের ২য় তলায় (বর্তমান উপজেলা) কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি টিম অবস্থান নিয়েছে- এ খবর শহরে ছড়িয়ে পড়ার পর তৎকালীন সংসদ সদস্য (এমএনএ) খাজা আহম্মদের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ, পুলিশ-ইপিআর-আনসার সদস্য নিজেদের একনলা-দোনলা বন্দুক নিয়ে সিও অফিস ঘেরাও করেন।

তাদের কাছ থেকে সিও অফিস দখলমুক্ত করে। হানাদারদের গুলিতে কয়েকজন আহত হলেও হানাদারদের একজনও সেদিন প্রাণে রক্ষা পায়নি। এ ঘটনার পর হানাদার বাহিনী ফেনী দখলে নেওয়ার জন্য ৮ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে দুটি যুদ্ধবিমান দিয়ে বোমা হামলা চালায়। এভাবে আরও তিনদিন ফেনীতে বিমান হামলা চালানো হয়। ১৬ এপ্রিলের হামলায় ফেনীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, তৎকালীন এমএনএ খাজা আহম্মদের নেতৃত্বে ফেনী পিটিআই স্কুল মাঠে ফেনী কলেজের ইউওটিসির ক্যাডেটসহ বিভিন্ন বয়সী যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। এদিকে হানাদার বাহিনীও ফেনী দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে। ২২ এপ্রিল খাজা আহম্মদসহ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা ভারতের বিলোনিয়ার চোত্তাখোলা একিনপুরে চলে যান। ২৩ তারিখ বাবা আবদুল মালেকও  বিলোনিয়া  চলে যান। এটা কারও জানা ছিল না। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট হয়ে গেছে। বাবা সঙ্গে নেই। এ অবস্থাতে  আমার পরিবারের মা, দুই ভাই, পাঁচ বোনসহ গ্রামে মামার বাড়ি চলে যাই।

তিনি বলেন, পরিবার দেখার তেমন কেউ না থাকলেও যুদ্ধে যেতে মনস্থির করি। মা আমাকে যুদ্ধে যেতে দিতে চাইছিলেন না। তবুও প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। কবিরকে সঙ্গে নিয়ে বিকেল চারটায় ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের কহুয়া গ্রামে কবিরের বাড়িতে উঠি। কাকডাকা ভোরে সীমান্ত পার হয়ে বিলোনিয়ার রাস্তা ধরে মতাই বাজারে পৌঁছাই। দুপুর নাগাদ বাবার কাছে গিয়ে পৌঁছাই।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ করি। প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের আগরতলা স্কুলে এনে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় যার যার এলাকায় পাঠানো হয়। চোত্তাখোলায় অন্যদের সঙ্গে একত্র হয়ে বাংলাদেশে ঢোকার প্রস্তুতি নেই। আমরা সব জিনিসপত্র নিয়ে দেশে ঢুকি। প্রথম সিন্দুরপুর ইউনিয়নের সেকান্তরপুর গ্রামে আকরাম হোসেন হুমায়ুনদের বাড়িতে উঠি। তাদের বাড়ির তিনদিকে নদী। দ্বিতীয় দিন লক্ষ্মীপুর গফুরদের বাড়িতে থাকি।

তৃতীয় দিন কোরবানপুর অজু মিয়াদের বাড়িতে অবস্থান নেওয়ার পরদিন বেলা ১১টার সময় রাজাপুরে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প হতে রাজাকারেরা আমাদের ঘেরাও করে। তারা আক্রমণ করবে খবর পেয়ে রাস্তার পূর্বদিক খোলা রেখে তিনদিকে অবস্থান নেই। বাড়ির তিনদিকের নালায় থাকা পাটিপাতা ও বেতমুড়ার জঙ্গলে অবস্থান নেই। ইতোমধ্যে রাজাকাররা পূর্বদিক থেকে গুলি করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। তারা আমাদের রেঞ্জের ভেতরে আসার পর আমরা এলএমজি, অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাই। হামলায় তাদের অনেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং কয়েকটি থ্রিনটথ্রি রাইফেল ফেলে পালিয়ে যায়। তখন থেকে বিরাট একটা এলাকা মুক্ত হিসাবে আমাদের আওতায় চলে আসে। আমাদের সাহস ও আস্থা বেড়ে যায়।

ফেনী জেলার সাবেক কমান্ডার আবদুল মোতালেব বলেন, ২/১ দিন পর খবর পাই, সোনবাগে কানকিরহাটে শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন ভূঞার নেতৃত্বে যে দল ছিল তাদের ওপর রাজাকার ও পাকিস্তান সেনাদের একটি দল আক্রমণ করে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেই কানকিরহাটের দিকে যাই এবং তাদের সঙ্গে থেকে যুদ্ধে অংশ নেই। সেখানেও রাজাকাররা পিছু হাটে এবং সেই এলাকাও মুক্ত হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, ইতোমধ্যে আমরা রাজাপুর ক্যাম্পে এবং বিরলী ব্রিজ রেকি করি। এলাকার আরও নিরাপত্তার জন্য এই ক্যাম্প ও ব্রিজ চলাচলের অনুপযোগী করা গেলে রাজাপুর, সিন্দুরপুর ক্রোশ মুন্সি দরবেশের হাট এলাকার জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে অবস্থান করতে পারবে।

তাই ২১ অক্টোবর রমজানের প্রথম রাত্রে দুই দলে বিভক্ত হয়ে বিরলী ব্রিজে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে চলাচলের অনুপযোগী করে দিই। এরপর রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থানরত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে রাজাকারদের বিতাড়িত করি। এরপর আমরা আমাদের এলাকাকে নিরাপদ করি।
তিনি বলেন, সোনাগাজী এলাকায়ও বিএলএফের (মুজিব বাহিনী) সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর যুদ্ধ হয়। ফাজিলপুর এলাকায়ও পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। ফেনী জেলার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে পাকবাহিনী ফেনী শহরে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম বীরত্বের সঙ্গে পরশুরাম, ফুলগাজীতে মুন্সিরহাট যুদ্ধ করে পাকিস্তান বাহিনীকে ফেনী শহরে অবস্থান নিতে বাধ্য করে। ৫ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানী বাহিনী নোয়াখালী হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে আর একটি গ্রুপ শুভপুর ব্রিজ হয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের দিকে চলে যায়।

আমরা ৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত করতে সক্ষম হই। চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ৬ তারিখে ফেনী শহরে একত্রিত হয়। সেই দিন যেন সাধারণ জনতার সঙ্গে সে বিজয় উল্লাস দেখেছি তা আমাদের যুদ্ধকালীন সকল কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। এই বিজয়ের পেছনে মুক্তিকামী জনতার সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগিতা না থাকলে এত তাড়াতাড়ি আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না।

×