ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

খালিয়ার রাজারাম মন্দির

প্রকাশিত: ২০:২৫, ৭ মে ২০২২

খালিয়ার রাজারাম মন্দির

মাদারীপুর জেলা ভাটিবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী একটি প্রাচীন জনপদ। বহুমাত্রিক এই ভাটিবঙ্গে নদ-নদী, বিল-বাঁওড় আর কৃষিভিত্তিক জীবনের নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন। এ সকল প্রাচীন নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে ৫শ’ বছরের প্রাচীন স্থাপত্য খালিয়ার রাজারাম মন্দির। রাজৈর উপজেলার প্রাচীন ভাস্কর্য শিল্পের অনুপম নিদর্শন খালিয়া রাজারাম মন্দির। সপ্তদশ শতাব্দীতে এটি নির্মিত। মন্দিরটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জেলার বহু প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে এটিই একমাত্র প্রাচীন নিদর্শন। খালিয়া ইউনিয়নের তৎকালীন জমিদার কালী সাধক রাজারাম রায় চৌধুরী এ মন্দিরটি বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মাণ করেন। নির্মাণের সঠিক দিন-তারিখ জানা যায়নি। এলাকায় প্রবীণ কোন ব্যক্তি বা বংশধর না থাকায় মন্দির নির্মাণ সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছু জানা যায়নি। শুধু নির্মাতার নামেই মন্দিরটি পরিচিত হয়ে উঠেছে। দর্শনীয় প্রাচীন এ স্থাপত্যটি বাংলার নির্মাণ শৈলির রীতিতে তৈরি বলে প্রাথমিকভাবে দেখে ধারণা করা হয়। সবুজ প্রকৃতির মাঝে এমন মনোরম ও চোখ জুড়ানো স্থাপত্য দেখে যে কারও মন জুড়িয়ে যায়। চারচালা বিশিষ্ট দ্বিতল এ মন্দিরটির গাঁথুনী চুন সুরকি দিয়ে। ২৩ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত মন্দিরের দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট, প্রস্থ ১৬ ফুট এবং উচ্চতা ৪৬ ফুট। দ্বিতল মন্দিরের এসব টেরাকোটায় রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্যাবলী এবং পান্ডবদের বিভিন্ন কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুণ দক্ষতায়। এছাড়া মন্দিরের গায়ে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবী, পশু পাখি ও লতা পাতার অসংখ্য চিত্র। চিত্রিত করা হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ও রামায়ণের কাহিনী। দক্ষ শিল্পীদের নিপুণ হাতের কারুকাজ ৫শ’ বছরেও দূর থেকে মানুষের মন কেড়ে নেয়। মন্দিরের অলঙ্করণের জন্য ব্যবহৃত টেরাকোটাগুলো সনাতন ধর্মীয় নানা দৃশ্যাবলী এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় যা পর্যটকদের আকর্ষণ করবে। মন্দিরের নিচতলায় ৬টি কক্ষ ও উপরের তলায় ৩টি কক্ষ রয়েছে। প্রথম দিকে জমিদার রাজারাম রায় চৌধুরী নিজেই এ মন্দিরে পূজা করতেন। বর্তমানে মন্দিরের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। দেয়ালে বটগাছ, শেওলা ও পরগাছা জন্মেছে। উপরের তলায় ভেতরের দিকে ফাটল দেখা দিয়েছে। যে কোন সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। কোথাও চুন সুরকি খসে পড়ছে। প্রাচীন এ স্থাপত্যটি বিগত কয়েক বছর ধরে জাতীয় জাদুঘর ও প্রতœতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। দেখাশোনার জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ একজন সাইড পরিচারক নিয়োগ দিয়েছে। তিনি শুধু মাঝে মাঝে এসে কিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। সারা বছর থাকে অরক্ষিত। জেলার এই নিদর্শনটি রক্ষণাবেক্ষণের কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। পর্যটকদের প্রবেশের জন্য প্রশস্ত কোন সড়ক নেই। এ যেন শুধু প্রাতিষ্ঠানিকতা আর নিয়ম রক্ষার পদক্ষেপ। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু মানুষ রাজারাম মন্দিরসহ খালিয়ার প্রচীন নিদর্শণগুলো দেখতে আসেন। এরই পাশে রয়েছে শান্তিকেন্দ্র নামে ছোট পার্ক ও পিকনিক স্পট, রয়েছে জমিদার রাজারাম রায় চৌধুরীর বাড়ি, জমিদার শিশির গাঙ্গুলীর বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। প্রাচীন দুর্গা মন্দির, রাজারাম ইনস্টিটিউশন, শিক্ষাবিদ ও লেখক পি.কে গুহ‘র বাড়ি। এর সবই অযত্ন, অবহেলা, উদাসীনতা আর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনেক স্থাপনা ইতোমধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, সরকারীভাবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে প্রাচীন স্থাপত্য রাজারাম মন্দিরসহ পুরো খালিয়া এলাকাটি অনায়াসে গড়ে উঠতে পারে এক নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র। যা থেকে দেশের পর্যটন খাতে আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর
×