‘খেজুর রস খেজুর গুড়, দক্ষিণের দ্বার মাদারীপুর।’ এ প্রবাদ বাক্যটি এক সময় মাদারীপুর জেলার জন্য প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু সেই প্রবাদবাক্য এখন ধীরে ধীরে ইতিহাস হতে চলেছে। ২০ থেকে ২৫ বছর আগেও এখানকার খেজুর গুড় ছিল এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। অথচ ভেজালমুক্ত খেজুর গুড় পাওয়াই এখন মুশকিল। যুগ যুগ ধরে এ ঐতিহ্যকে লালন করেছেন খেজুর গুড় উৎপাদনকারী হাজারো গাছি ও ব্যবসায়ী। শুধু তাই নয় এ ঐতিহ্যগত মৌসুমী শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল এ অঞ্চলের হাজার হাজার গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা।
প্রতি বছর কার্তিক থেকে ফাল্গুন মাস অর্থাৎ হেমন্ত ও শীত-বসন্তের মাঝামাঝি চার মাস খেজুর গুড়ের মৌসুম। এ মৌসুমে খেজুর গুড়ের ম-ম গন্ধে খুঁজে পাওয়া যেত আবহমান বাংলার প্রকৃত রূপ। ফুটন্ত প্রভাতে কুয়াশার চাদর জড়ানো শীতের সকালে মিঠে-কড়া রোদে বসে খেজুর রসের স্বাদ মনে করিয়ে দিয়েছে খাঁটি বাঙালিয়ানা। ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে গরম গুড়ের লালী পাটালী ও হাজারী গুড়ের লোভনীয় স্বাদ কি ভোলা যায় কখনো? অথচ আজ পারিপার্শি¦ক নানা কারণ ও যান্ত্রিক সভ্যতার যাঁতাকলে পড়ে একশ্রেণির মানুষের মনে অতি লোভ-লালসার জন্ম হওয়ায় তাদের ভেতরে নকল বা ভেজাল প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ প্রবণতা বেশিদিনের নয়; মাত্র ২৫/৩০ বছরের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করে। যা বর্তমানে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নকল বা ভেজাল প্রবণতা ক্যান্সারের রূপ নিয়ে এক বিধ্বংসী আকার ধারণ করেছে। যে কারণে ভেজালমুক্ত গুড় এখন আর আশা করা যায় না। এই ভেজালের কবলে পড়ে এক সময়ের ঐতিহ্য জেলার খেজুর গুড় তার নিজস্ব ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। দিন দিন অতি মুনাফাখোর ও অসাধু গুড় উৎপাদনকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠায় গুড়ের হারানো ঐতিহ্য আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। ভেজাল গুড়ে এখন হাট-বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। গুড়ের ওজন বৃদ্ধি করতে চিনি আর রং ফর্সা করতে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। যে কারণে সুস্বাদু খেজুর গুড় এখন দুর্লভ হয়ে পড়েছে। গত ২৫/৩০ বছর ধরে এ অবস্থা চলে আসলেও নেয়া হয়নি কোন আইনি ব্যবস্থা। ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ফলে পার পেয়ে যাচ্ছে অসাধু গুড় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা।
ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলের খেজুর গুড়ের সুখ্যাতির জন্য ব্রিটিশ সরকার এখানকার গুড় কলকাতা নিয়ে চিনি প্রস্তুত করতো। তাদের তৈরি এ চিনির নাম ছিল ‘ব্রাউন সুগার’। সে সময় ইংরেজ সাহেবরা মাদারীপুর ও যশোর অঞ্চলের খেজুর গুড়ের পাটালী লন্ডনে নিয়ে যেত। ব্রিটিশ আমলের আগ থেকে এ অঞ্চলের খেজুর গুড় বিখ্যাত ছিল। তখন সনাতনী কায়দায় গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হতো। আজ কয়েক‘শ বছর পরে এখনো সেই সনাতনী পদ্ধতিতে রস সংগ্রহ করা হয় এবং লম্বা চুলায় টিনের ‘তাফাল’ (ছোট ডোঙ্গা) বা লম্বা ধরনের ‘জাইল্যা’ (মাটির তৈরি লম্বা কলস জাতীয় পাত্র) দিয়ে রস জ্বাল করে খেজুর গুড়ের পাটালী তৈরি করা হয়। খেজুর রস সংগ্রহে ও গুড় তৈরিতে আজও কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি। তাই এটা শুধু ঐতিহ্যই নয়; এটা বাংলা ও বাঙালীর গৌরবের ইতিহাস। যা শত শত বছর ধরে চলে আসছে। খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য হারালেও; গুড় তৈরির সনাতনী পদ্ধতি এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে।
শুধু তাই নয় প্রকৃতিক দুর্যোগ ও নানা প্রতিকুলতার কারণে জেলার খেজুর গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাওয়ায় গুড়ের উৎপাদন ১০-১৫ ভাগে নেমে এসেছে। পৃষ্ঠপোষকতা ও সংরক্ষনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে এই বঙ্গের ঐতিহ্য খেজুর গুড় ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগের মতো খেজুর গাছে রস হয় না। আগের দিনে এ অঞ্চলের শত শত গাছের রসে হাড়ি
ভরে যেত; গাছিরা মধ্যরাতে হাঁড়ি পাল্টে দিয়েছে, সকালে গাছ থেকে রসে ভরা হাঁড়ি নামিয়েছে। অর্থাৎ এক গাছে দুই হাঁড়ি রস উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু আজকাল রসের উৎপাদন এতোটাই কমে গেছে যে, সন্ধারাতে গাছের আবরণ ছেঁচে হাঁড়ি লাগালে পরদিন সকালে অর্ধেক হাঁড়ি রসও পাওয়া যায় না। এ কারণে গাছিদের শ্রমের মূল্য না উঠায় অনেকে খেজুর গাছ ‘ঝুরা’ (রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা) বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পেশা বদলে ফেলেছে। এক সময় প্রতি বছর শীত মৌসুমে নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গুড় উৎপাদনের সঙ্গে জড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থান খুঁজে পেত জেলার ৩৫/৪০ হাজার মানুষ। খেজুর গুড়ের উৎপাদন কমে যাওয়ায় সেই বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তা ছাড়া খেজুর গাছ থেকে যে পরিমাণ জ্বালানি পাওয়া যেত তাতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর ৬ মাসের জ্বালানি চাহিদা মিটাতে পারতো। এখন আর সে অবস্থা নেই। তাই থেমে গেছে গ্রামীণ জনপদের প্রাণচাঞ্চল্য। ধীরে ধীরে বেকার হয়ে পড়ছেন খেজুর গুড়ের ওপর নির্ভর করে থাকা মৌসুমি শ্রমিকরা।
মাদারীপুর জেলার খেজুর গুড়ের সুখ্যাতির জন্য অনেক উৎপাদনকারী গাছি পুরস্কারও পেয়েছেন। সে সময় খেজুর গুড়কে কেন্দ্র ভাটি অঞ্চলের লোকখাদ্যে সমৃদ্ধ হয় বহুগুণ। এখন খেজুর গুড়ের তৈরি লোকখাদ্যের গুণগতমান হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে শীত মৌসুমে এসব লোকখাদ্যের কদর ও চাহিদাও কমে গেছে।
জনশ্রুতি রয়েছে স্বাধীনতার পরবর্তী চার দশক আগে মাদারীপুর, কালকিনি, রাজৈর ও শিবচর উপজেলায় প্রায় ১২ লাখ খেজুর গাছ ছিল। ক্রমাগত ঝড়, বন্যা, সিডর ও নদী ভাঙ্গনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে খেজুর গাছের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভাব-অনটনের সুযোগ নিয়ে ইটভাটির মালিক ও লাকড়ি ব্যবসায়ীরা ১০/১৫ টাকা মণ দরে খেজুর গাছ ক্রয় করতে থাকে। এভাবে ইট ভাটার জ্বালানির চাহিদা মিটাতে উজাড় হতে থাকে জেলার খেজুর বাগান। নব্বইয়ের দশকে এ সংখ্যা নেমে আসে ৪ লাখের নিচে। একই সঙ্গে গুড়ের উৎপাদন কমে নেমে এসেছে ১০ ভাগের ১৫ ভাগে। গুড়ের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাওয়ায় গাছি ও গুড় উৎপাদনকারীরা বেশি মুনাফা লাভের আশায় গুড়ে চিনি ও বিষাক্ত সালফার মিশিয়ে বাজারজাত শুরু করে। যা বর্তসানেও চলমান রেখেছে খেজুর গুড় উৎপাদনকারীরা। আগের কুলনায় গুড়ের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৮০ ভাগ, অথচ দাম বেড়েছে ৮-১০ গুণ। ভেজাল গুড় ক্রয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার কারণে ক্রেতার সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পেয়ে বর্তমানে নেমে এসেছে ১৮-২০ ভাগে। এ জেলার ভোজন রশিকদের মুখরোচক তালিকায় ছিল খেজুর গুড়ের তৈরি সব ধরনের লোকখাদ্য সামগ্রী। এখন এ সব খাদ্য সামগ্রী তৈরি হলেও শতভাগ ভেজালমুক্ত নয়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, ভেজালমুক্ত খেজুর গুড় এখন অতীত।
চল্লিশের দশকে যখন এ জেলায় খেজুর গাছের সংখ্যা ছিলো প্রায় ১২ লাখ। তখন প্রতি শীত মৌসুমে এ সব খেজুর গাছ থেকে প্রায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫০ মণ গুড় উৎপন্ন হয়েছে। সে সময় এর মূল্য ছিল প্রতি কেজি ১০ টাকা দরে অর্থাৎ প্রতি মণ ৪০০ টাকা হিসেবে ১৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তখন এ জেলার গুড় এলাকার চাহিদা পূরণ করেও দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হতো। মাদারীপুরের সুস্বাদু গুড়ের পাটালি, নলেন গুড়, দানাদার গুড়, হাজারী গুড় ও ঝোলা (পাতলা) গুড়ের সুনাম ছিল দেশ ব্যাপী। কেউ কেউ শখ করে এখানকার খেজুর গুড় বিদেশে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠাতেন। সে সময় উৎপাদনকারীরা গুড়ে ভেজাল দেওয়ার চিন্তাও করতেন না। কিন্তু বর্তমানে সে চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। ভেজাল ছাড়া ১ কেজি গুড়ও বাজারে পাওয়া যায় না। এলাকার ঐতিহ্য ও সুনাম রক্ষায় কারও কোন মাথাব্যথা নেই। শুধু অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ভাবে চলতে থাকলে এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে সুস্বাদু খেজুর গুড়ের অস্তিত্ব। মানুষ ভুলে যাবে আবহমান বাংলার পৌষ-পার্বণের উৎসব আর শীতের পিঠা-পায়েস ও লোকখাদ্যের কথা। এখন খাঁটি বা ভেজালমুক্ত গুড় পেতে হলে ৩/৪ দিন আগে গাছিদের নগদ টাকা বায়না দিতে হয়। তবে সেক্ষেত্রে গুড়ের দাম অনেক বেশি। প্রতি কেজি সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা প্রতি কেজি। যদি গুড় উৎপাদনকারী একটু বিবেকবান হয় তাহলেই কেবল ভেজালমুক্ত খেজুর গুড় পাওয়া সম্ভব। এই নির্ভেজাল গুড়ের স্বাদ ও গন্ধ আগের মতই পাওয়া যাবে।
সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর