রুয়ে কলা না কাটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত- গ্রাম বাংলায় খনার বচন হিসেবে পরিচিতি এ কথাগুলো সত্য হয়ে উঠেছে সামাদ কাজী নামের এক ব্যক্তির জাদুর হাতে। ফরিদপুর সদরের ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা মান্নান কাজীর ছেলে সামাদ কাজী (৪৫)। আট বছর আগে বাড়ির পাশে মাত্র চার বিঘা জমি ইজারা নিয়ে তিনি কলার বাগান করেন। আট বছর পর তিনি ফরিদপুর সদরের নর্থ চ্যানেল, ডিক্রির চর ও ঈশান গোপালপুর ইউনিয়ন এবং পাশের গোয়ালন্দ এলাকার অন্তত চারশ’ বিঘা কলার বাগানের মালিক। যদিও বর্তমানে তিনিসহ এ কাজে যুক্ত রয়েছেন তার চার অংশীদার।
সামাদ কাজীর ভাষায়, আমি অত্যন্ত ঠেকা (দরিদ্র) মানুষ ছিলাম। লেখা পড়া করিনি। কোন জমি জিরাত ছিল না। মানুষের জমিতে কৃষাণ দিয়া সংসার চালাইতাম। এক সময় আমার মনে হইলো এভাবে দিন কাটে না, কাটতে পারে না। তাই কলা চাষের দিকে মন দেই। আট বছর আগের কথা। বাড়ির পাশে চার বিষা জমি পাঁচ বছরে ৪০ হাজার টাকায় ইজারা নিয়ে তিনি কলা চাষ করেন। ওই জমিতে দেশী জাতের এক হাজার ২০০টি সবরি কলার চাড়া রোপণ করেন তিনি। গরিব মানুষ। লোকজন নেননি। নিজেই জমি তৈরি করা, চাড়া রোপণ করা, সার দেওয়া ও পরিচর্যা করেন। এক বছরে তার সব খরচপাতি বাদ দিয়ে দুই লাখ টাকা আয় হয়। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চর এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় এখন তার ৪০০ বিঘা জমিতে কলা চাষ করেন। সাথে চারজন অংশীদার যুক্ত হয়েছে পরবর্তীতে।
সামাদ পড়াশোনা করেননি। তার ভাষায়, ‘পড়াশোনা করিনি অভাবের কারণে। আমরা চার ভাই ও এক বোন। অভাবের সংসারে পেটে ঠিকমতো খাবরই জুটতো না।’ গর্বের সঙ্গে বলেন সামাদ, ‘তবে কাজ জানি। কাজ করি এবং মানুষের সঙ্গে সহজেই মিশতে পারি বলে, কেউ ধরতেই পারেন না যে আমি পড়াশোনা জানি না।’
তিন মেয়ে ও এক ছেলের বাবা সামাদ কাজী। নিজে পড়াশোনা না করলেও ছেলে ও মেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছেন। বড় মেয়ে সুমি আক্তার এইচ এস সি পাস করার পর বিয়ে দিয়েছেন। মেঝে মেয়ে উর্মি আক্তার এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ছোট মেয়ে শাহানা আক্তার তৃতীয় ও একমাত্র ছেলে আব্দুল্লাহ কাজী দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
সামাদের স্ত্রী রেশমা খাতুন বলেন, উনি নিজে পড়াশোনা করেননি বলে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে সব সময়ই আন্তরিক ছিলেন। নিজের মতো তার ছেলেমেয়ে যেন নিরক্ষর না থাকে এ মানসিকতা থেকে তিনি সব সন্তানকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। সামাদ কলা বিক্রি করে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ৩৭ শতাংশ জমি কিনে তার ওপর একটি সেমি পাকা ঘর তুলেছেন। এখন কলা বিক্রি করে সামাদ ও তাঁর চার অংশীদার অনেক লাভবান। বছরে কলা বিক্রি হয় প্রায় তিন কোটি টাকার। ঢাকার ওয়াইজ ঘাট, তেজগাঁও, শ্যামবাজার, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে সামাদের কলা বিক্রি হয়। ব্যাপারিরা নিজেরা এসে বাগান ধরে কলা কিনে নিয়ে যান। সামাদ বলেন, আমার কলা খুব সুসাধু। আমি গাছে কোন রাসায়নিক সার দেই না। দেই জৈব সার। এর ফলে কলার মূল স্বাদ অপরিবর্তিত থাকে।
সামাদের কলা সংগ্রহ করে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করেন আরিফ বাজার এলাকার তারা শেখ নামে এক ব্যাপারী। তারা শেখ জানান, দেশী জাতের কলা চাষ করেন সামাদ। তার কলার স্বাদ ভাল। এজন্য তার কলার চাহিদা বাজারে অপরিসীম। ঢাকার বিভিন্ন বাজারে এ কলা নিয়ে গেলে আমাদের বিক্রি করতে একটুও বেগ পেতে হয় না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে ফরিদপুরের নয়টি উপজেলাতেই কম বেশি কলার চাষ হয়। তবে সদর ও সদরপুর উপজেলা কলা চাষ বেশি হয়। জেলায় কলার আবাদ দিনে দিনে বাড়ছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে কলার আবাদ করা হয়েছে ৮৬০ হেক্টর জমিতে। এর আগের অর্থ বছর ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে কলার আবাদ হয়েছিল ৮১০ হেক্টর জমিতে। গত অর্থ বছরে ফরিদপুরে কলা উৎপাদন হয়েছে ২১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। জেলায় কলা আবাদের দিকে থেকে চতুর্থ এবং উৎপাদনের দিক থেকে তৃতীয় অর্থকারী ফল।
-অভিজিৎ রায়, ফরিদপুর থেকে