
নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর ॥ পরচুল বা ‘হেয়ার ক্যাপ’ তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে শেরপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী গ্রামে বেকার নারীদের হাতে গড়ে উঠা ওই কারখানায় পরচুল বা ‘হেয়ার ক্যাপ’ তৈরি করে দিন দিন স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন অনেকেই। ‘টাক মাথা’য় ব্যবহারের জন্য ওইসব পরচুল তৈরিতে কাজ করছে এলাকার শতাধিক হতদরিদ্র নারী ও স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী। তাদের প্রতি মাসে আয়ও হচ্ছে ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা।
অন্যদিকে ওইসব হেয়ার ক্যাপ এখন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার বাইরেও বিশেষ করে ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। এতে ওই হেয়ারক্যাপ তৈরির কাজে নিয়োজিত নারীরা একদিকে যেমন হয়ে উঠছেন আত্মপ্রত্যয়ী ও স্বাবলম্বী, অন্যদিকে এলাকার আরও বেকার নারীরাও হয়ে উঠছেন উৎসাহী।
সীমান্তবর্তী নন্নী ইউনিয়নের নন্নী পশ্চিমপাড়া গ্রামে গড়ে উঠা ওই হেয়ার ক্যাপ তৈরির মিনি কারখানার উদ্যোক্তা স্থানীয় এক স্কুল কর্মচারী আবু তালেব। প্রায় ৫ বছর পূর্বে আবু তালেব তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার উত্তরা এলাকার ‘শিশির হেয়ার পার্ক’ নামে একটি পরচুল বা ‘হেয়ার ক্যাপ’ তৈরির কারখানার খোঁজ পান। সেখান থেকে তিনি চুক্তিভিত্তিক প্রথম পর্যায় সামান্য কিছু চুল, সুই-সুতাসহ হেয়ার ক্যাপ তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে এসে তার স্ত্রী ইসমত আরাকে ঢাকায় ট্রেনিং করান।
গ্রামে ফিরে আবু তালেব ও তার স্ত্রী প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রামের হতদরিদ্র ২০ জন নারীকে ট্রেনিং দিয়ে পরচুল তৈরির কাজে লাগিয়ে দেন। এরপর আবু তালেবকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিশেষ ধরনের টেবিল তৈরি করে তিনি নিজ বাড়িতেই একটি মিনি কারখানা গড়ে তোলেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন তার কারখানায় কাজ করছেন ৭৫ জন নারী।
এছাড়া নিজেদের সুবিধার জন্য অনেক নারী তাদের বাড়িতেই পরচুল তৈরি করে তালেবের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। একজন দক্ষ নারী শ্রমিক ২ দিনে একটি করে পরচুল তৈরি করতে পারেন। প্রতিটি পরচুলের মজুরি সাইজ অনুযায়ী ৪শ থেকে ৬শ টাকা। কোম্পানীর সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিনি ৭ টি সাইজের তৈরি করা প্রায় ২’শ থেকে ২’শ ৫০টি পরচুল সরবরাহ করেন, যার বাজার মূল্য ২ লাখ থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
সরেজমিনে গেলে কথা হয় উদ্যোক্তা আবু তালেব, তার স্ত্রী ইসমত আরাসহ হেয়ার ক্যাপ তৈরির কাজে নিয়োজিত নারীদের সাথে। ইসমত আরা জানান, প্রথমে আমি ঢাকায় গিয়ে নিজে কাজ শিখে গ্রামের অনেক মেয়েকে ট্রেনিং দিয়ে তাদের কর্মমুখী করে তুলি।
লাভজনক ওই কাজে এখন এ গ্রামের অনেক হতদরিদ্র নারীসহ স্কুলগামী মেয়েরাও বেশ আগ্রহী হয়ে উঠছে। পশ্চিমপাড়া গ্রামের নারী আয়শা বেগম জানান, শুরু থেকেই এখানে কাজ করছি। বর্তমানে মাসে ৬ হাজার টাকা আয় করছি। এ টাকা দিয়ে সংসারের খরচসহ ভাই-বোনদের লেখা-পড়ার খরচ চালাচ্ছি।
স্থানীয় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী বৃষ্টি জানায়, টাকার জন্য তার লেখাপড়া করতে কষ্ট হওয়ায় সে গত দেড় বছর যাবত পরচুল তৈরির কাজ করছে। এখন মাসে সে প্রায় ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছে। একই গ্রামের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুলতানা জানায়, তার অসুস্থ বাবা কর্মঅক্ষম হওয়ায় ৩ মাস আগে সে পরচুল তৈরির কাজ শিখে কাজে বসছে। বর্তমানে মাসে সে প্রায় ২ থেকে ২ হাজার ৫শ টাকা আয় করছে।
কর্মউদ্যোগ, পরিশ্রম আর সদিচ্ছাই স্বাবলম্বীতা এনে দিতে পারে- এমন অভিমত ব্যক্ত করে ওই হেয়ারক্যাপ তৈরির কারখানার উদ্যোক্তা আবু তালেব জানান, প্রথমে নিজের সংসারের কথা চিন্তা করে হেয়ার ক্যাপ বা পরচুল তৈরির কাজ নিয়ে আসলেও এখন গ্রামের অনেক শিক্ষিত ও বেকার নারী আগ্রহী হয়ে উঠছে পরচুল তৈরির কাজ করতে।
কোন রকম সরকারি-বেসরকারি সহায়তা ছাড়া আমার হাতে গড়া কারখানায় বর্তমানে ৭৫ জন নারী এবং গ্রামের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে আরও প্রায় ৫০ জন নারী নিজেদের সংসারের কাজের ফাঁকে পরচুল তৈরি করে আমার কাছে সরবরাহ করছে। ওইসব পরচুল তৈরির জন্য চুল ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি আমাকে ঢাকা থেকেই সরবরাহ করা হয়। মাস শেষে ঢাকায় গিয়ে মজুরির টাকা ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে নিয়ে এসে সকলকে নগদে পরিশোধ করি। তবে এ কাজের জন্য সরকারি কোন সহযোগিতা পেলে আমার কারখানা আরও বড় করা সম্ভব হতো। এতে গ্রামের আরও অনেক হতদরিদ্র নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো।
এ বিষয়ে জেলা বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক আবুল কালাম মোঃ শামস উদ্দিন বলেন, হেয়ার ক্যাপ তৈরির কারখানা গড়তে তাদের সহায়তা চাওয়া হয়নি। এ কাজে গ্রুপভিত্তিক এগিয়ে এলে তাদের ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণসহ ঋণ সুবিধা দেওয়ারও সুযোগ রয়েছে।