
ছবি: জনকণ্ঠ
শেরপুরের গ্রামীণ জনপদে একসময় মাটির ঘর ছিল এক পরিচিত দৃশ্য। প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এসব ঘর ছিল পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যকর ও নান্দনিক। কালের পরিক্রমায় আজ সেই ঘরগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। আধুনিক নির্মাণশৈলীর দাপটে বিলুপ্তির পথে শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর।
মাটির ঘরের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এর নির্মাণ উপাদান স্থানীয় মাটি, খড় ও বাঁশের ব্যবহার। প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি এসব ঘর গ্রীষ্মকালে ঠাণ্ডা ও শীতকালে উষ্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করত। বিশেষ করে ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলার পাহাড়ঘেঁষা অঞ্চলে মাটির ঘরের প্রচলন ছিল বেশি। বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও গ্রামীণ পরিবারগুলো এই ঘর ব্যবহার করত। এটি শুধু বাসস্থান ছিল না, বরং একটি সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতিচ্ছবি ছিল।
তবে বর্তমানে এই ঘরের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় টিন, ইট, সিমেন্ট ও রডের ব্যবহার বেড়ে গেছে। মানুষ দ্রুত ও মজবুত ঘর নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফলে প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি ঘরগুলোকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হচ্ছে। এক সময়ের কারিগররাও এখন আর এই ঘর নির্মাণে আগ্রহী নন, কারণ চাহিদা নেই বললেই চলে। অনেকে পেশা বদল করে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন।
শ্রীবরদী উপজেলার রানীশিমুল ইউনিয়নের মোবারক হোসেন জানান, মাটির ঘর ছিল আত্মীয়তার বন্ধনের প্রতীক। পরিবারের সবাই মিলে একসাথে ঘর তুলতেন, দেয়ালে দিতেন পুঁতির নকশা বা আলপনা। বৃষ্টির দিনে মাটির ঘরের ছাদে বৃষ্টি পড়ার শব্দ আজো তাদের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম এসব অনুভূতির সাথে পরিচিত নয়।
রাণীশিমূল ইউনিয়নের বাসিন্দা আবু সাইদ দিনার বলেন মাটির ঘর পরিবেশবান্ধব এবং কার্বন নিঃসরণহীন। এটি নির্মাণে বিদ্যুৎ বা ভারী যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না, ফলে পরিবেশে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে না। তবে যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই ঘর টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার পক্ষ থেকেও এই ঐতিহ্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
হাসধরা গ্রামের খাইরুল ইসলাম বলেন মাটির ঘর শুধু ঐতিহ্য নয়, বরং টেকসই বাসস্থানের উদাহরণ। এটি আবহাওয়ার উপযোগী ও খরচেও তুলনামূলক কম। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, নকশার আধুনিকীকরণ ও মাটির ঘর নির্মাণে প্রশিক্ষণ। স্থানীয় পর্যায়ে প্রকল্প হাতে নেওয়া গেলে আবারও এই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
শেরপুরের মাটির ঘর কেবল একটি নির্মাণকৌশল নয় এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, আবেগ ও পরিবেশসচেতনতার প্রতীক। এই ঐতিহ্য রক্ষায় এখনই উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধুই বইয়ের পাতায় পড়বে মাটির ঘরের গল্প
সাব্বির