ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

অগ্রহায়ণ ছিল বাংলা সনের প্রথম মাস

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

অগ্রহায়ণ ছিল বাংলা সনের প্রথম মাস

আগন মাস তো আল্যো। কাটামাড়ি শুরু হয়া গেল। আগন্যে লেপে ঝকঝকা করা লাগবি। ও বৌ-নবান করব্যে কুন দিন! নয়া চালের কি সোন্দর বা¯œা। বেটি জামাইওক নাইয়র আনা লাগবি। পিঠার জন্যি ঢেঁকিত চাউল কাট্যে আটা করো। গ্রামের এই কথার অর্থ হলো- অগ্রহায়ণ মাস তো এলো। মাড়াইকাটাই শুরু হলো। আঙিনা মাটি পানি দিয়ে লেপে ঝকঝকে করতে হবে। ও বউ নবান্ন করবে কোন দিন! নতুন চালের কি সুঘ্রাণ। মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করে আনতে হবে। ঢেঁকিতে চাল ভেনে পিঠার জন্য আটা কর। নবান্নে গ্রামীন জীবনের এমন সংলাপ সেদিনও ছিল। আজও আছে। আগামীতে চিরন্তন হয়ে থাকবে। বাঙালীর জীবনে নবান্নের আবেদন সামাজিক থেকে সাংস্কৃতিক। সেখান থেকে রূপাতীত হয়ে সংস্কৃতির রন্ধ্রে পৌঁছে গেছে। অগ্রহায়ণ আসে নবান্নের উৎসব হয়। এই নবান্নে জড়িয়ে আছে প্রাচীন ইতিহাস। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়ে সেই ইতিহাস হৃদয় থেকে হৃদয়ের পাতায় অদৃশ্যে লেখা হয়ে আছে। যা দেখতে হয় হৃদয় দিয়ে। চিরন্তন ধারায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা দেখছে প্রকাশের আরেক প্রবাহিত রূপের বর্ণিল পরিচয়ে। একটা সময় কার্তিক মাস এলেই গ্রামের সাধারণের মধ্যে উৎকণ্ঠা জাগত। কী করে পার করা যাবে কার্তিক! যার নামই ছিল ‘মরা কার্তিক’। একদা দেশের উত্তরাঞ্চলে আশ্বিন-কার্তিক মাসের পরিচিতি ছিল তীব্র অভাবের মাস। ‘মঙ্গা’ নামে বেশি পরিচিত। পত্রপত্রিকাগুলো কার্তিক মাসে মঙ্গা খুঁজতে পা বাড়াত উত্তরাঞ্চলে গ্রামের পথে। সেই সময়ে মঙ্গা রিপোর্ট ছিল শিশির ভেজা কাহিনী। সেই কার্তিক আজ অতীতের উপাখ্যান। যারা প্রবীণ ও মধ্য বয়সী তাদের চোখে মঙ্গা ঝাপসা হয়ে এসেছে। প্রজন্মরা দেখছে মঙ্গার মেঘ কেটে কীভাবে ঝলমলে রোদ উঠেছে। এমন রোদের আগেও মঙ্গার শেষে যেভাবে আনন্দের নবান্ন আসত আজও সেই আনন্দ আসে। তবে তা পালাবদল হয়ে। বর্তমানে ভর বছর কোন না কোন ধান উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষকের আর একদ- ফুরসত নেই। কী আশ্বিন কী কার্তিক- ধান আছেই। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সকল মৌসুমের উপযোগী ধান উদ্ভাবন করেছে। অগ্রহায়ণ প্রতিটি ঘরেই বয়ে আনে উৎসবের বন্যা। অগ্রহায়ণ নিয়ে বড় ইতিহাস আছে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে খাজনা আদায়ের মাস ছিল অগ্রহায়ণ। সম্রাট আকবর প্রথমে চান্দ্র মাস (লুনার) দিয়ে রাজত্বের হিসাব-নিকাশ করতেন। পরে তিনি সোলার বা সৌর ক্যালেন্ডারের হিসাব শুরু করেন। সৌর মতের বছর গণনার পদ্ধতিও প্রাচীন। বৈশাখ আগে বছরের প্রথম মাস ছিল না। অতীতে এই মাস একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। কখনও প্রথমে কখনও মাঝামাঝিতে এসেছে। একাদশ শতকে গুজরাতি প-িত হেমচন্দ্রসুরী তাঁর ‘অভিধান চিন্তামণি’ গ্রন্থে অব্দ বা বছরের বিভিন্ন মাসের তালিকা শুরু করেন অগ্রহায়ণ মাস দিয়ে। ড. নীহার রঞ্জন রায় বলেছেন এক সময় অগ্রহায়ণ মাসে বাংলা নববর্ষের সূত্রপাত হতো। তখন নবান্ন ছিল বর্ষ শুরুর দিন। ‘অগ্রহায়ণ’ নামই তার প্রমাণ। ফসলের ও চাষের সঙ্গে রয়েছে বাংলা মাসের গভীর সম্পর্ক। আদিম মানুষের আর্তব উৎসব নবান্ন। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে প্রকৃতির রং রূপের পরিবর্তন ঘটে। সেই পালায় প্রকৃতি নবান্নকে বর্ণিল করে আনে। অগ্রহায়ণ মাস এলেই ভরা ক্ষেতে সোনালি ধানের গুচ্ছে মধুর হাসি নিয়ে আসে নবান্ন। সেদিনের নবান্ন ছিল এরকম- কিষাণবধূ নিজের বাড়ির উঠান লেপে ঝকঝকে পরিষ্কার করে রাখে। এই উঠানেই কিষাণ নতুন ধান কেটে আটি সাজিয়ে রাখে। তারপর এই আটি গোল করে বিছিয়ে দেয়। দুই বা চার গরু ঘুরে ঘুরে পা দিয়ে খচে আটি থেকে ধান ছাড়িয়ে নেয়। তারপর আটি আলগা করে সেই খড় পালা দেয়। ধান সিদ্ধ শুকান করে ঢেঁকিতে ভেনে নতুন চাল বের করে নেয়। চাল ভিজিয়ে ঢেঁকিতে ছেঁটে আটা করা হয়। নতুন চালের ভাতেই হয় নবান্ন। বাড়তি ফিরনি পায়েস। চালের আটায় তৈরি হয় পিঠাপুলি। নবান্নের এই ধারা গিয়ে ঠেকে শীতের পিঠাপুলি উৎসবে। গ্রামেও নবান্নের উৎসবের নানা আয়োজন হতো। জ্যোৎ¯œা রাতে বজরা নৌকায় ঢাক বাজিয়ে নদী পথে অনেকটা দূর যাওয়া হতো। রাতের এই ঢাকের আওয়াজে নদী তীরের লোকজন জেগে উঠে নাচ শুরু করেছে। আনন্দের এই নাচ ছিল নবান্নের। একটা সময় নবান্নের খাদ্য তালিকায় মাছ ও শাক-সবজিসহ নয়টি পদের খাবার ছিল। নয় পদ থাকায় বলা হতো নয় যোগ অন্ন সমান নবান্ন। তবে এই অর্থ একটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। নবান্ন নতুন অন্ন হিসাবে অধিক সমাদৃত। বর্তমানে কৃষিতে যন্ত্রের আগমনে ধান মাড়াই-কাটাই, ধান ভেনে চাল সবই যন্ত্রে। কৃষির এই পরিবর্তনে নবান্নের উৎসবও বর্ণিল হয়েছে। আগে নবান্নের আনুষ্ঠানিকতা ছিল গৃহস্থ ও কিষাণ ঘরে স্বল্প পরিসরে। বর্তমানে গাঁয়ের বধূরা নবান্নের আগে এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে গীত গায়। বরণ করে নেয় নবান্ন। তারপর প্রতিটি ঘরেই উৎসবের পালা শুরু হয়ে যায়। যা চলে অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×