ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

পাল সম্প্রদায় বিলুপ্তির পথে

প্রকাশিত: ০১:১০, ৪ এপ্রিল ২০১৬

পাল সম্প্রদায় বিলুপ্তির পথে

স্টাফ রিপোর্টার, ঈশ্বরদী ॥ বাঙ্গালি সংস্কৃতির সাথে আদিকাল থেকে নানা ভাবে জড়িয়ে আছে দেশের পাল সম্প্রদায়ের কৃষ্টি-কালচাল ও কারুকাজ খঁচিত মৃৎ শিল্পের চাহিদা । আদিকাল থেকেই পাল সম্প্রদায়ের মৃৎ শিল্পীদের তৈরী মাটির হাড়ি,পাতিল,থালা,বদনা, কলসী-সড়ই,ঢোঁকসা,সাড়া, ভাতের হাড়ি ,হাড়ির ঢাকনা , ফুলের টব, ব্যাংক, ফুলদানী, কুয়ার পাটসহ নানা প্রকার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে ব্যবহার হয়ে আসছে । এ কারণে আদিকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশি পাল সম্প্রদায়েরও বসতি গড়ে ওঠে । একসময় হাটবাজারে ও গ্রামাঞ্চলের মেলাতেও জমজমাট ভাবে মাটির তৈরী জিনিসপত্র বিক্রি হতো । এখনও বিক্রি হয় । তবে আগের মতো চাহিদা না থাকায় তেমন হারে বিক্রি হয়না । কালের পরিবর্তন এবং বিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে সাথে দেশের মানুষের কৃষ্টিকালচাল, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা ও ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে । বর্তমান আধুনিকায়নের যুগে মেলামাইন,ষ্টিল ও প্লাষ্টিকের তৈরী জিনিসপত্র দেশের প্রায় সকল অঞ্চলের মানুষের নিত্য চাহিদা মেটাতে সক্ষম হলেও পাল সম্প্রদায়ের মাটির তৈরী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা শেষ হয়ে যায়নি । প্রায় সকল অঞ্চলেই এখনও মাটির তৈরী জিনিসপত্রের অনেক চাহিদা রয়েছে । আর এসব চাহিদা পাল সম্প্রদায়ের মৃৎ শিল্পীরাই পুরণ করে যাচ্ছে । যদিও কর্মসংস্থানের অভাব,সামাজিক অবহেলা,রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা কারণে এ সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা বর্তমানে অনেক কমেগেছে । মেলা ভিত্তিক মৃৎ শিল্পটি ক্ষুদ্র শিল্পের স্বীকৃতি না পাওয়ায় পাল সম্প্রদায়ের মানুষ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । ঈশ্বরদী অঞ্চল বৃটিশ আমল থেকেই সমৃদ্ধ । যোগাযোগসহ নানা কারণেই বৃটিশরা এ অঞ্চলকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসাবে বেছে নেয় । সে সময় থেকেই সাঁড়াঘাট এলাকায় বিদেশী নাবিকদের নানা প্রকার জাহাজ নোঙর করতো এই ঘাটে ।মূলতঃ ওই সময় থেকেই সাঁড়া ইউনিয়নের পদ্মা নদীর তীর এলাকায় পাল সম্প্রদায়ের বসবাস শুরু হয় । তাদের আয়ের একমাত্র উৎস ছিল মাটি দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় আকর্ষনীয় জিনিসপত্র তৈরী ও বিক্রি করা । বেশী চাহিদা থাকায় এখানকার তৈরী জিনিসপত্র বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো । তখন এ এলাকায় অন্তত ঃ তিন শতাধিক পরিবারে পাল সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল । একইভাবে মুলাডুলি ইউনিয়নের রেলগেট এলাকাতেও প্রায় এক’শ পরিবার মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল । একদিকে বিজ্ঞানের উন্নয়ন , অন্যদিকে পদ্মা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গন এসব পরিবারের সদস্যদের ভিটে ছাড়া ও কর্মহীন করে তোলে । নদীর ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ও মৃৎ শিল্পের চাহিদা কমতে থাকায় এ শিল্পের ধবস নামতে থাকে । এ কারণে অনেকেই বাঁচার তাগিদে কর্মপরিবর্তণ করতে বাধ্য হয় । এভাবেই সাঁড়ার পাল পাড়া ও মুলাডুলির পাল পাড়া ছোট হতে হতে একেবারেই ছোট আকার ধারণ করেছে । এখন ওই পাড়া দেখলে পাল পাড়া বলে বিশ্বস করতে কষ্ট হয় । সাঁড়ার পল পাড়ায় এখন মাত্র ১৫ টি পরিবার আর মুলাডুলিতে ৭টি পরিবার বসবাস করছে । কোন রকমে তারা মৃৎ শিল্পের ব্যবসা ধরে রেখেছে । সাঁড়া পাল পাড়ার গুরপদের স্ত্রী মুক্তারানী ,দুখু পালের স্ত্রী সাবিত্রি,বাসুদেব রায়ের স্ত্রী সাধনা রানী ও ফুরাং পাল জানান, নদী ভাঙ্গনে তাদের সর্বোস্ব হারিয়ে গেছে । এখন তারা ভাড়া করা বাড়িতে বসবাস করছেন । মৃৎ শিল্পের খুব একটা চাহিদাও নেই । যতটুকু চাহিদা আছে তা পুরণ করার মতো অর্থ নেই । সরকারী কোন সাহায্যও দেওয়া হয়না । তাই কোন মতে কষ্ট করে জীবিকার তাগিদে ছেলে মেয়েদের জন্য ব্যাংক,সাড়া ঢোকসা,টব,কুয়ার পাত ,হাড়িপাতিল বানিয়ে ঈশ^রদীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি । শুধুমাত্র অবহেলা আর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাল সম্প্রদায় ও মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িতরা বর্তমান করুণ অবস্থার মধ্যে হাবুডুব খাচ্ছে ।
×