ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

দিনবদলের চেষ্টায় নতুন মোহামেডান

প্রকাশিত: ১২:৩৪, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

দিনবদলের চেষ্টায় নতুন মোহামেডান

দীর্ঘদিন অযতœ আর অবহেলায় পড়ে থাকা রং তুলি দিয়ে আঁকা আলপনা একটা সময় ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করে। কোন এক সময় তা হারিয়েই যায়। ঢাকা মোহামেডানের অবস্থা অনেকটাই যেন সেই দীর্ঘদিন অযতেœ আর অবহেলায় পড়ে থাকা আলপনার মতোই ছিল। জয় করা ট্রফির শোকেসে শেষবারের মতো কোন্ ট্রফিটা ঠাঁই পেয়েছে তা বলা মুশকিল। তবে ট্রফির গায়ে ধুলোর আবরণ বলে দেয় নতুন ট্রফি রাখার জন্য শোকেসের গ্লাস খোলা হয়নি অনেকদিন। কিন্তু ১৯৩৬ সালে আবির্ভূত হওয়া ঢাকা মোহামেডানের সাফল্যের কাহিনী বলতে গেলে শেষ করা যাবে না। এ বিষয়ে কথা হয় বর্ষীয়ান সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের সঙ্গে। মোহামেডানের উত্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, মোহাম্মদ শাহজাহান যিনি কলকাতা লীগে সেখানে মোহামেডানের অধিনায়কত্ব করেন। ঢাকা মোহামেডানের জেনারেল সেক্রেটারি হন ১৯৫৬ সালে। তিনি ক্লাবে নিয়ে আসেন শিল্পপতি গুল মোঃ আদমজীকে ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও বিসিক সুপার ইঞ্জিনিয়ার মইনুল ইসলামকে। এদিকে ভাগ্যও তাকে সহায়তা করে। ১৯৫৫ সালে লীগের শেষ দিকে ওয়ান্ডার্সের ৭/৮ জন দলছুট ফুটবলার একযোগে মোহামেডানে যোগ দিলে মোহামেডান রাতারাতি শক্তিশালী দলে পরিণত হয়। ওই বছর ওয়ান্ডার্স ও মোহামেডানের পয়েন্ট সমান হলে চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণের জন্য ‘প্লে-অফ’ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ওয়ান্ডার্সের কাছে হেরে মোহামেডান রানার্সআপ হয়। শুরু হয় ঢাকা মোহামেডানের উত্থান। তাদের ক্লাব ভবন নির্মিত হয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ঠিক দক্ষিণ পাশের জমিতে। পরের বছর (১৯৫৭) ঢাকা মোহামেডান তাদের প্রথম লীগ শিরপা জয় করে স্থাপন করে স্মরণীয় মাইল ফলক। সেই যে যাত্রা শুরু তা ধারাবাহিকতা না থাকলেও ফুটবল হকি ক্রিকেট এ্যাথলেটিক্স এ তাদের সাফল্য মোহামেডানকে দেশের সবচেয়ে সফল ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান বা ক্লাব-এ অভিষিক্ত করেছে। ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং আজ বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে সফল, নন্দিত ও বন্দিত নাম। দেশের খেলাধুলায় এক গৌরবান্বিত অংশ। সেই থেকেই মোহামেডানের যাত্রা শুরু। দেশ স্বাধীনের পর দেখা মিলে নীল হলুদ রঙের আবাহনী ক্রীড়া চক্রের। মোহামেডান-আবাহনী প্রথম মোকাবেলাতেই প-, নাম লিখিয়ে ফেলে চীর প্রতিদ্বন্দ্বীর। ফুটবল হকি ক্রিকেট মানেই যেন মোহামেডান-আবাহনী যুদ্ধ। আবাহনী-মোহামেডান ফুটবলে নিজেদের হয়ে রেকর্ড গড়েছে এবং ভেঙ্গেছে। যারা নিয়মিত খেলা দেখেছেন নিশ্চয়ই মনে আছে আবাহনী ১৯৮৩, ৮৪ এবং ৮৫ সালে হ্যাটট্রিক লীগ শিরোপা জয় করে মোহামেডান শিবিরে হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছিল। মোহামেডান সমর্থকরা ধরেই নিয়েছিল এই রেকর্ড আর কখনই ভাঙবে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে পরবর্তী ১৯৮৬, ৮৭ ও ৮৮-৮৯ সালেই মোহামেডান হ্যাটট্রিক লিগ বিজয় করে। আর মোহামেডানের সমর্থকদের বাড়তি পাওনা ছিল অপরাজিত হ্যাট্রিক লিগ চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮৬ সালে আবাহনী ফেডারেশন কাপ ফুটবল সেমিফাইনালে মোহামেডানকে টাইব্রেকারে হারিয়ে ফাইনালে উঠে। ওই সময়কার সেরা বিদেশী ফরওয়ার্ড শ্রীলঙ্কান প্রেমলাল আবাহনীর হয়ে মোহামেডানের বিরুদ্ধে করেন হ্যাটট্রিক। স্টেডিয়ামের এক পাশে আনন্দ উল্লাস আর আরেক পাশে মোহামেডান সমর্থকদের ফাইনালে না ওঠার বেদনা, সঙ্গে প্রেমলালের হ্যাটট্রিক যেন বুকের মধ্যে পেরেক মেরে দিয়েছিল। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর সেই হ্যাটট্রিকের বদলা নেয় মোহামেডান। ২০০০ সালে মোহামেডান আবাহনীর লিগের খেলা চলছে। আবাহনী উড়িয়ে এনেছিল ভারতীয় খেলোয়াড় সাব্বির পাশা। মাঠে নেমেই ৯ মিনিটে কেনেডির থ্রোইন গোল মুখে পড়লে সাব্বির পাশা হেড করে গোল করেন। দর্শকদের উল্লাস কমতে না কমতেই আবার গোল খেয়ে বসে মোহামেডান। ১৫ মিনিটে ফয়সাল এবং জুয়েল রানাকে কাটিয়ে সাব্বির পাশা বক্সে চমৎকার ক্রস দিলে ডনের দুর্বল শটে পরাস্ত হন পনির। আবাহনী ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার পরও দুটি নিশ্চিত গোলের সুযোগ নষ্ট হয়। পরবর্তীতে নাকিব ৩৩, ৫২ এবং ৭০ মিনিটে অসাধারণ গোল করে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন (৩-২)। শেষে এই খেলায় মোহামেডান ৪-৩ গোলে এক অবিস্মরণীয় বিজয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে। স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ দর্শক সেদিন এই খেলা দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই খেলা আর সেই দর্শক আজ কোথায়? আবাহনী তাদের চ্যাম্পিয়নের ধারা ধরে রাখলেও মোহামেডান একেবারেই নিস্ফল, নিশ্চুপ। ফুটবলে সেই ২০০৫ সালে শেষ বারের মতো চ্যাম্পিয়ন, মাঝখানে স্বাধীনতা কাপ একবার আর সুপার কাপ দুইবার। সমর্থকদের আনন্দে ভাসাবার মতো আর কোন ঘটনা ঘটেনি। ক্যাসিনোর ঝামেলায় পড়ে মোহামেডানের পরিচালক লোকমান হোসেন ভুঁইয়া ক্লাব থেকে দূরে। এদিকে ফুটবলারদের দলবদল। মোহামেডান যেন মাঝি ছাড়া নৌকা। এমনিতেই দলের অবস্থা খারাপ তার ওপর এই হাল। যাদের রক্তে মোহামেডান, যারা একদিন মোহামেডানের সাদাকালো জার্সি গায়ে চাপিয়ে বহু জয় করায়ত্ত্ব করেছেন, যাদের জাদুকরী পায়ের কারুকাজে মোহামেডান সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন তারা আজ ঠিকই মোহামেডানের এমন দুর্দিনে বসে থাকতে পারেননি। তাইতো সেই ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, বাদল রায়, রিয়াজ, রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বির, ছাইদ হাসান কানন, কায়সার হামিদ, আলফাজ ও সংগঠক আবু নাসের প্রিন্সসহ অনেক সাবেকরা ছুটে গেছেন ক্লাবের দুর্যোগ মুহূর্তে। মোহামেডানের পরিচালক সারোয়ার হোসেন এবং মোস্তাকুর রহমান এর সঙ্গে আলোচনা করে দল গঠনের কাজে নেমেছেন। যদিও ইতোমধ্যে সব দল প্রায় ঘর গোছানোর কাজ সেরে ফেলেছে তবুও মোহামেডান শেষ মুহূর্তে গতবারের সাত জনসহ মোট ২৬ জন খেলোয়াড়কে দলভুক্ত করেছে। গতবারের দ্বিতীয় লেগে পাওয়া ইংলিশ কোচ সেন লি এবার থাকছেন মূল কোচের দায়িত্বে সঙ্গে মালির স্ট্রাইকার সোলেমান এবং জাপানিজ মিডফিল্ডার উরুই নাকাতা। জানা গেছে, এবার কোচের পছন্দে ভাল মানের তিনজন বিদেশী আসছে সাদাকালো শিবিরে। কোচ সেন লি মুচকি হাসি দিয়ে আগামী মৌসুমে সেরা পাঁচের মধ্যে থাকার ইংগিত দিলেও তার মুচকি হাসির ভিতরের রহস্যটা রেখে দিয়েছেন। গত মৌসুমে কোচ লি এবং সোলেমান মোহামেডানের সমর্থকদের ভালবাসার প্রতিদান দিতে বদ্ধপরিকর। নতুন করে দল ঢেলে সাজানো প্রসঙ্গে ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব বলেন, যে সব খেলোয়াড় দলে নেওয়া হয়েছে তারা সবাই বয়সে তরুন উদীয়মান। এদের সঙ্গে ভাল মানের ৩/৪টা ফরেন খেলোয়াড় রিক্রুট করতে পারলে শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলোর সঙ্গে মানের দিক থেকে খুব একটা তারতম্য হবে না। কারণ মূলত ফলাফল গড়ে দেয় ফরেন খেলোয়াড়রা। সাবেকদের অনেকেই প্রতিদিন আসছেন ক্লাবে। আসছে ক্লাবের সমর্থকেরা। সকলের ইচ্ছা ক্লাব আবার সেই আগের ধারায় ফিরে আসুক। ঐতিহ্যের পালকে আবারও সাফল্য সংযুক্ত করতে চান সব অঙ্গনেই। তবে সকলের অভিমত ক্লাবের নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচন হলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্ল্যান মাফিক ক্লাবের কার্য পরিচালনা করতে পারবে। দীর্ঘদিন ঝিমিয়ে পড়া মোহামেডান যেন জেগে উঠেছে। সাবেক খেলোয়াড়দের সঙ্গে সমর্থকদের আনাগোনা ক্লাবকে যেন সরব করে তুলেছে। বাংলাদেশের কোটি সমর্থকদের প্রিয় ক্লাব নিশ্চয় ঘুরে দাঁড়াবে। সবাই মুখিয়ে আছে নতুন মোহামেডানকে দেখার জন্য। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ঐতিহ্যের পালকে সংযোগ হোক নতুন সাফল্য। ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া আলপনায় নতুন তুলির আঁচড়ে হয়ে উঠুক রঙিন। রঙিনের ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত হোক সাদাকালো তাঁবু। এখন পর্যন্ত মোহামেডানে যাদের খেলা নিশ্চিত হয়েছে ॥ গোলরক্ষকÑআহসান হাবীব বিপু (মোহামেডান), মাজহারুল ইসলাম হিমেল (আরামবাগ), জসিম উদ্দিন (সেনাবাহিনী)। ডিফেন্ডারÑশ্যামল (মোহামেডান), আতিকুজ্জামান (আরামবাগ), হুমায়ুন কবির (সেনাবাহিনী), মাসুদ রানা (নোফেল এস সি), কামরুল ইসলাম (নোফেল এস সি), ইমন খান (সকার ক্লাব ফেনি/ বাংলাদেশ অনুর্ধ- ১৯), ফরহাদুজ্জামান বাবু (শেখ রাসেল), সাব্বির আহমেদ সুমন (বিজেএমসি) মিডফিল্ডÑহাবিবুর রহমান সোহাগ (মোহামেডান), ইউসুফ সিফাত (মোহামেডান), অনীক ঘোষ, মিঠু ভুইয়া (মোহামেডান), সোহানুর রহমান সোহান (বসুন্ধরা কিংস), ফরহাদ মনা (নোফেল এস সি), শাহেদ হোসেন (চট্টগ্রাম আবাহনী), অনীক হোসেন (চট্টগ্রাম আবাহনী), আবিদ হোসেন সাইফ (ভিক্টোরিয়া), কবির হোসেন (সাইফ এস সি), রাকিব খান ইভান (মুক্তিযোদ্ধা), রুম্মন হোসেন (শেখ রাসেল) ফরোয়ার্ডÑআমীর হাকিম বাপ্পি (মোহামেডান), আমিনুর রহমান সজীব (শেখ রাসেল), ওসাই মং মারমা (সাইফ এস সি)।
×