ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছয় জেলায় চাষ;###;গড় ফলন ৩ টন করে হলেও কোথাও কোথাও সাড়ে ৪ টনের ওপরে;###;ছয় জেলার চালের বাজারেও কিছুটা স্বস্তি;###;কৃষির বৈরী পরিবেশে ভাল ফলন অত্যন্ত ইতিবাচক

কৃষকের মুখে হাসি ॥ আগাম আমনের বাম্পার

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৮ অক্টোবর ২০১৭

কৃষকের মুখে হাসি ॥ আগাম আমনের বাম্পার

এমদাদুল হক তুহিন/ তাহমিন হক ববী ॥ দেশের ৬ জেলায় চলতি মৌসুমে আগাম জাতের আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলাগুলোতে হেক্টরপ্রতি গড়ে ৩ টন করে আগাম আমনের উৎপাদন হলেও কোন কোন জেলায় সাড়ে ৪ টনের ওপরেও ফলন পাওয়া গেছে। নীলফামারী ও দিনাজপুরে সাড়ে ৪ টনের ওপরে উৎপাদন হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। আগাম আমনের কর্তন শুরু হয়েছে কুড়িগ্রামেও। পোকামাকড়ের আক্রমণে জেলাটিতে আমন ধানের কিছুটা ক্ষতি হলেও শেষ মুহূর্তে তুলনামূলকভাবে ভাল ফলন হয়েছে। ভাল ফলন পাওয়ায় পঞ্চগড়ের বাজারেও কিছুটা স্বস্তি দেখা গেছে। মৌসুমটিতে রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও মানিকগঞ্জে আগাম জাতের আমন ধানের ভাল ফলন পাওয়ায়Ñ জেলাগুলোতে কৃষকের মুখে এখন হাসির ঝিলিক। নতুন ধান ওঠায় ওই জেলাগুলোর চালের বাজারেও কিছুটা প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কৃষক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ গোলাম মারুফ জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের ৬ জেলায় আমনের আগাম ধান কাটা প্রায় শেষ হয়েছে। ফলন হয়েছে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৩ টন করে। আমনের আগাম ধানের ভাল ফলন পাওয়া দেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। যখন চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে, তখন চাষীর ঘরে নতুন ধান উঠছে। এতে বাজারে কিছুটা স্বস্তি দেখা দিয়েছে। এতে ওই অঞ্চলগুলোতে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ফেলো ও কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. এম আসাদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, আগাম জাতের আমন ধানে ভাল ফলন পাওয়া দেশের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক। নতুন ধান ওঠায় ওই ৬ জেলার চালের বাজারে বর্তমানে কিছুটা প্রভাব পড়লেও ভবিষ্যতে এটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি বলেন, সামনের বছর যদি বর্তমানের ৩ গুণ জায়গায় আগাম জাতের আমন আবাদ করা যায় বাজার ব্যবস্থায় এটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। কারণ, আগাম আমন ২০ থেকে ৩০ দিন আগেই বাজারে আসে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে দেশের ৬ জেলায় ৯২ হাজার ৯৯২ হেক্টর জমিতে আগাম আমনের আবাদ হয়েছে। সপ্তাহের প্রথমদিকে ৭৮ হাজার ৬৫ হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হলেও বর্তমানে প্রায় সব জমির ধান কাটা প্রায় শেষ হয়েছে। আবাদ হওয়া জেলাগুলো হচ্ছেÑ রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও মানিকগঞ্জ। সরেজমিন উইংয়ের তথ্যমতে, এই ৬ জেলায় আমনের আগাম কর্তন প্রায় শেষ পর্যায়ে। কর্তনকৃত আগাম জাতের মধ্যে আছে- টিয়া, ময়না, স্বর্ণা, জাগরণ, ধানীগোল্ড, ইস্পাহানি, এসিআই, এসিআই-১, এসিআই-২, ব্রিধান-৩৩, ব্রিধান-৬২, হীরা-২ ও বিনা ধান-৭। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায় হাইব্রিড জাতের আমন ধান কাটা প্রায় শেষ হয়েছে। অঞ্চলটিতে বেশ ভাল ফলন হয়েছে। যেসব কৃষক ইস্পাহানি-২ হাইব্রিড আমন ধান রোপণ করেছিলেন তাদের জমিতে ৪ টনেরও বেশি করে ফলন হয়েছে। এ ধানে একদিকে কৃষক যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তেমনি ধান ও চালের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাল এবং ধানের বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। পঞ্চগড়েও আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে ওই অঞ্চলের বাজারে স্বস্তি দেখা গেছে। কুড়িগ্রামেও আগাম আমন উঠতে শুরু করেছে। কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রাম জেলায় চলতি আমন মৌসুমে আগাম ধান উঠতে শুরু করেছে। শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন ক্ষেতে পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দেয়ায় ধানের কিছুটা ক্ষতি হলেও তুলনামূলকভাবে ফলন ভাল হয়েছে। কৃষকের মুখে এখন হাসির ঝিলিক। জানা গেছে, জেলাটিতে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম ধান রোপণ হয়েছিল। তথ্যমতে, ২ হাজার ২৮০ হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। কুড়িগ্রাম কৃষি বিভাগের উপপরিচালক মকবুল হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, আমনের অধিকাংশ ক্ষেতে ধানের শীষ এসেছে। তবে আগাম জাতের ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে। এই ধান কেটে সরিষা লাগাবেন জেলার কৃষকরা। বন্যার পরও সারা জেলায় বেশ ভাল ফলন হয়েছে। নীলফামারীতে পূর্বের যে কোন বছরে চেয়ে এবার আগাম আমনের উৎপাদন বেশি হয়েছে। জেলাটিতে গড় ফলন ৪ দশমিক ৬৯ টন। নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, রংপুর কৃষি অঞ্চলের মধ্যে নীলফামারীতেই সবচেয়ে বেশি আগাম জাতের আমনের আবাদ হয়ে থাকে। চলতি মৌসুমে জেলাটিতে ২০ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে আগাম আমনের আবাদ হয়। এরমধ্যে উফসী জাতের আবাদ হয় ৪ হাজার ৩৬৪ হেক্টর জমিতে ও বাকি ১২ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয় হাইব্রিড জাতের ধান। জেলাটিতে এখন পর্যন্ত আগাম আমনের আবাদ হয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯৫ টন। সমপরিমাণ এই ধান থেকে ৬২ হাজার ৫৯৬ টন চাল হওয়ার কথা রয়েছে। জানা গেছে, রবিবার পর্যন্ত এই ধান কাটাই মাড়াই সম্পন্ন হয়েছে ১৭ হাজার ৮ হেক্টরের। বাকি তিন হাজার ১২ হেক্টর জমির ধান আগামী ৭ দিনের মধ্যে কাটাই মাড়াই শেষ হয়ে যাবে বলে কৃষক ও কৃষি বিভাগ মনে করছে। আগাম আমন চাষীর কথা ॥ নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী গ্রামের কৃষক দুলাল হোসেন (৪৫)। গত বছরের চেয়ে ২ বিঘা বেশি জমিতে এবার তিনি আগাম জাতের আমন আবাদ করেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, গত ১০ বছর ধরে আগাম জাতের আমন আবাদ করে আসছি। ধান কাটা শেষ হয়েছে আরও আগেই। এখন ওই জমিতে আলু আবাদ করছি। ধানের ফলন এবারও ভাল হয়েছে। আবার একই জমিতে আলুর ফলনও ভাল হয়। জানালেন, হাইব্রিড জাতের আমনে এবার প্রতিবিঘা জমিতে ১৬ মণ করে ধান পেয়েছেন তিনি। একইভাবে কৃষক বলরাম চন্দ্র রায় এবার দেড় বিঘা জমিতে চায়না জাতের আগাম আমন আবাদ করেন। আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, ‘এইটা আমাদের মঙ্গা খেদার ধান। ধান কাটি আগাম আলু করা যায়। কিন্তু এই ধান আবাদ করি ধানও পাওয়া যায়, আগাম আলুও গারা যায়।’ জানালেন, দেড় বিঘা জমিতে তিনি ২৪ মণ ধান পেয়েছেন। বিগত সময়ের উৎপাদনও প্রায় একই বলে জানান তিনি। নীলফামারী জেলা সদরের সোনারায় গ্রামের কৃষক আবির হোসেন (৫০)। জানালেন, এবার তিনি ৭ বিঘা জমিতে আগাম জাতের আমন আবাদ করেন। জনকণ্ঠকে বলেন, দুই বিঘা জমিতে উফশী জাতের ধান আবাদ করে ফলন পেয়েছি ১৩ মণ করে মোট ২৬ মণ। আর বাকি ৫ বিঘা জমিতে হাইব্রিড ধান আবাদ করে বিঘাপ্রতি সাড়ে ১৬ মণ করে সাড়ে ৮২ মণ। এখন একই জমি আলু চাষের জন্য তৈরি করছি। তিনি আরও বলেন, আগে আগাম জাতের আলু চাষ করার জন্য জমি ফেলে রাখতে হতো। এখন আগাম জাতের চায়না ও হাইব্রিড ধান আসায় জমি ফেলে রাখতে হয় না। তাছাড়া ধান আবাদের পর আগাম আলু চাষ করলে ওই জমিতে আলুর ফলনও ভাল হয়। ওই অঞ্চলের একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগাম জাতের আমনের আবাদে ফলন যেমন বেশি হচ্ছে তেমনি ফসল উৎপাদনে ওই অঞ্চলে লেগেছে বহুমুখীকরণের ছোঁয়া। এতে কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। বাজারেও অন্তত ১০ থেকে ২০ দিন আগে আসছে নতুন ধানের চাল। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ৬ জেলায় আগাম আমনের বাম্পার ফলন হওয়া কৃষির এই বৈরী পরিবেশে অত্যন্ত ইতিবাচক। এটি সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থায় কিঞ্চিত হলেও প্রভাব ফেলতে পারে।
×