ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতির পাতায় এখনও উজ্জ্বল স্টপারব্যাক মনি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৭ মে ২০১৭

স্মৃতির পাতায় এখনও উজ্জ্বল স্টপারব্যাক মনি

স্বাধীনতাত্তোর ফুটবলের স্বর্ণময় দিনগুলোর কথা কার না টানে। খুব একটা বেশিদিন আগের কথা নয়। ’৭০ আর ’৮০-এর দশকের সেই বর্ণময় ফুটবল ক্রীড়ামোদীদের স্মৃতির সাগরে এখনও অতলান্ত ঢেউ তুলে। আর সেই ঢেউ তোলার নাবিকেরা ক্রীড়ামোদীদের স্মৃতির পাতায়ও সমান উজ্জ¦ল। স্মৃতির পাতা উল্টালেই যেন চোখে পড়ে সেই স্বর্ণযুগের তারকাখচিত ফুটবলারদের। যাদের ঘিরে আবর্তিত হতো সমর্থকদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, পাগলামি। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান এবং তারুণ্যদ্বীপ্ত আবাহনী ক্রীড়া চক্রে সে সময় যারাই ফুটবল খেলেছেন তারাই রাতারাতি সেলিব্রেটি হয়েছেন। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া-ক্ষ্যাপাটে, অন্ধ ফুটবলমোদীদের ভীষণ ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন তারা। সেই তাদের অনেকেরই এ প্রজন্মেও সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্ব। কেননা কারণে-অকারণে তারা চলে গেছেন চোখের আড়ালে। যাপিতজীবনের ব্যস্ততায় ফুটবল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। অনেকেই পেশা আর ঘর-সংসার নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। দেশান্তরি হয়েছেন কেউ কেউ। ফলে বর্তমান কর্পোরেট ফুটবল আঙিনায় তাদের দেখা মেলে সেভাবে না। সত্তুর আর আশির দশকের সেই স্বর্ণযুগের এমনই এক তারকা ফুটবলার মনি। পুরো নাম মো. মজিদুল ইসলাম মনি। ক্রীড়ামোদীরা যাকে এখনও ‘আবাহনীর স্টপার ব্যাক মনি’ বলেই বেশি চেনেন। তবে শুধু আবাহনী নয়, মোহামেডান, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, রহমতগঞ্জ ক্লাবেও তিনি খেলেছেন। কিন্তু জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি ছিল তার আবাহনীতেই। এ কারণেই এখনও ‘আবাহনীর মনি’ হিসেবেই তিনি নন্দিত এবং চিহ্নিত। মনির ফুটবল হাতখড়িটা ছিল নিজ জেলা শহর পাবনা থেকেই। পৈত্রিক বাড়ি পাবনা কাচারিপাড়াতে হওয়ায় খেলাধুলোর শুরুটাও ছিল ওখানেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে স্কুল জীবন থেকেই ছিল ফুটবলের সঙ্গে নৈকট্য। স্কুল-কলেজ দলের পর সে সময় জেলা দলের হয়ে খেলে নিজের প্রতিভা মেলে ধরেন। তবে ফুটবলাঙ্গনে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই একাত্তরের রণাঙ্গনে সক্রিয় থাকেন। মুজিববাহিনীর হয়ে দেরাদুন থেকে হাসানুল হক ইনু, মাসুদ আহমেদ রুমীর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ এলাকায় এসে রফিকুল ইসলাম বকুলের তত্ত্বাবধানে পাকসেনাদের সঙ্গে লড়াই-এ অবতীর্ণ হন। ৭৪ সালে পাবনা লীগে অভিষেক ঘটে তার। এরপরের বছরই ’৭৫ সালে ঢাকা ওয়াপদা টিমের তৎকালীন ফুটবলার বাচ্চুর চোখে পড়ে মনির ফুটবল নৈপুণ্য। একই শহরের মানুষ হওয়ার কারণে তিনি ওই বছরই প্রথম মনিকে ঢাকাতে নিয়ে আসেন। ওয়াপদা টিমের কোচ তখন স্কটল্যান্ডের স্যান্ডি। কোচিং-এ তিনিও মনির মাঝে ফুটবল কুশলতা খুঁজে পান। তবে ওয়াপদাতে সেভাবে খেলার সুযোগ মেলে না মনির। সাইড লাইনেই বসে দিন কাটাতে হয়। পরের বছর ৭৬ সালে রক্ষণভাগের ফুটবলার হামিদের সঙ্গে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দেন তিনি। আজাদের হয়ে মিডফিল্ডে খেলার সুযোগ পান। তবে সে সময় দুর্দান্ত ফুটবলার নান্নু, মঞ্জুকে সামনে রেখে বড় ক্লাবে খেলার স্বপ্ন রচনা করতে থাকেন তিনি। স্বপ্নপূরণে সংকল্পব্ধও হন। ’৭৮ সালে মনির ভাগ্যের দরজা খুলে যায়। ব্রাদার্সের সে সময়কার দুই তুখোড় ফুটবলার সেলিম এবং বাবলুর আমন্ত্রণে তিনি যোগ দেন গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে। ব্রাদার্সে তিন বছর কাটানোর পর আবাহনীতে নাম লেখান তিনি। ফুটবলার মনি ৮১ থেকে ৮৩ টানা তিনি বছর আবাহনী শিবিরের অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন। সে জমানায় আবাহনী আর মোহামেডানের রক্তহিম করা ফুটবল লড়াই জমে উঠতো। ফল দু ক্লাবের খেলোয়াড়দের নিয়ে যে উচ্ছ্বাস তৈরি হতো তা এখন কল্পনাতেও আনা কঠিন। ওয়াপদা, ব্রাদার্স ক্লাব হয়ে মনি যখন ৮১ সালে প্রথম আবাহনী ক্রীড়া চক্রে নাম লেখান তখন আবাহনী শিবিরের ফরোয়ার্ড লাইনে কিংবদন্তি ফুটবলার কাজী সালাহউদ্দিন, চুন্নু, আনোয়ার, অমলেশ। মাঝে মাঠে আশীষ, খুরশীদ বাবুল। ডিফেন্স লাইনে পান শ্রীলঙ্কার পাকির আলী, অশোকা ডি সিলভা, নান্নু, হেলালকে। আর কোচ হিসেবে পান ফুটবল ইনটেলেকচুয়াল আবদুর রহিমকে। প্রথমবারের মতো আবাহনীতে নাম লিখিয়েই সতীর্থদের সঙ্গে অপূর্ব ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করতে সমর্থ হন মনি। লীগে আবাহনী ক্রীড়া চক্র অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। মূলত এ সময়েই স্টপারব্যাক মনির নাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ক্লাব সমর্থকদের ফুলেল ভালবাসায় সিক্ত হন তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তাকে। আবাহনীর প্রতিটি ম্যাচেই রক্ষণভাগ সামলানোর কঠিন দায়িত্ব পরত তার উপরই। পরের দুবছরও টানা আবাহনীতে খেলেন তিনি। ৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সামরিক শাসনামলে ফুটবলে যে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের ঘটনা সেই ঘটনায় তাকেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আর্মি কন্ট্রোল রুমে নেয়া হয়। ৮৪ সালে মনি দলবদল করে প্রিয় দল আবাহনী ছেড়ে চলে আসেন ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। এর পরের বছরেই রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি ক্লাবে নাম লেখান। মাঝে কাস্টমস বিভাগে ফুটবলার হিসেবে চাকরি নেন। চাকরি সূত্রে চলে যান চট্টগ্রামে। প্রথম বিভাগ ফুটবল থেকে বিদায় নেন। এরপর ৯১ সাল পর্যন্ত কাস্টমসের হয়ে বিভিন্ন জায়গাতে খেলেন। মনির জাতীয় দলের হয়ে খেলার অধ্যায়টাও বেশ উজ্জ্বল এবং গৌরবময়। পারফরমেন্স দিয়েই জাতীয় দলের অপরিহার্য খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। ৭৮ সালে প্রথম সুযোগ পান পশ্চিম জার্মানির কোচ ওয়ার্নার বেকেলহফটের এশিয়ান যুব ফুটবল উপলক্ষে আয়োজিত যুব প্রশিক্ষণ শিবিরে। ২২ জনের দলের থাকলেও খেলার সুযোগ পাননি। তবে ৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২২তম এশিয়ান যুব ফুটবলে খেলার সুযোগ পান। এরপর ৮১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে লাল দলের হয়ে দারুণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন মনি। এরপর একের পর এক ৮২ সালে পাকিস্তানে করাচিতে অনুষ্ঠিত কায়েদা আজম ট্রফি, ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস, ৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট কাপের লাল দলে, একই বছরে মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপ খেলেন। ৮৪ সালে ইন্দোনেশিয়াতে অনুষ্ঠিত অষ্টম এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে খেলেন। মনি স্টপার ব্যাক পজিশনেই নিয়মিত খেলেছেন। লড়াকু ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। দেশ ও দেশের বাইরে অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্য প্রদর্শন করে তাই দর্শক নন্দিত হন। স্টপারব্যাকে নির্ভরযোগ্য হওয়ার কারণেই ক্লাব কর্মকর্তাদের কাছে ছিলেন আস্থা আর বিশ্বাসের প্রতীক। স্টপার ব্যাক পজিশনে খেলে তিনি যতটুকু অমরত্ব লাভ করেছেন তার কৃতিত্ব প্রয়াত কোচ গফুর বেলুচের। তার মতে, ব্রাদার্সে খেলার সময় কোচ পফুর বেলুচই এই পজিশনের জন্যে তাকে তৈরি করেন। সাবেক তারকাদের অনেকেই ফুটবলের বিভিন্ন আযোজনে সম্পৃক্ত হলেও ব্যতিক্রম মনি। খেলা ছেড়ে দেয়ার পর চাকরি জীবনে বড় বেশি ডুবে থাকেন। ফলে চোখের আড়ালেও চলে যান। কিন্তু আবাহনী, মোহামেডানে যিনি খেলেছেন তিনি চাইলেই চোখের আড়ালে যেতে পারেন না। মনিও তাই মনে করেন। বর্তমানে ফুটবলের অবনমনে অনেকের মতো মনিও বেদনাহত। হিসেব মেলাতে পারেন না। তবে মনে করেন, ফুটলার তৈরির যে পথগুলো সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। মনির অভিযোগ স্কুল কলেজে আগের মতো ফুটবল চর্চ হয় না। জেলাগুলোতে লীগ বন্ধ হয়ে গেছে। এ সব কারণেই তৃণমূল প্রতিভাগুলো আবিষ্কৃত হচ্ছে না। ফুটবলের বর্তমান সঙ্কট কাটিয়ে উঠা সম্পর্কে মনি বলেন, ‘আমিতো মনে করি বাংলাদেশের ফুটবলের এখন যে অবস্থা তা থেকে বের করে আনা সম্ভব। বড় দাগে বললে এর জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। কিন্তু যেটা দেখছি ফুটবল নিয়ে প্রচুর কথা হচ্ছে কিন্তু ফুটবলের উন্নয়নটাই হচ্ছে না।’ মনি আরও বলেন, ‘মাঝে মাঝে খেলা দেখতে মাঠে যাই। ইচ্ছে করেই নীরবে গিয়ে গ্যালারিতে বসি। জনগণের মতামত শুনি ও বুঝার চেষ্টা করি। মাঝে একটা ম্যাচ দেখতে গিয়ে ভীষণ হতাশ হই। শেখ জামাল ক্লাব আর আবাহনীর খেলাÑ অথচ মাঠে দর্শক নেই। এটা কী মেনে নেয়ার মতো বিষয়। ফুটবলের এই দুরাবস্থায় মাথা নিচু হয়ে আসে।’ পুরনো স্মৃতি টেনে বলেন, ‘দেখুন, দক্ষিণ এশিয়ায় একসময় আমরা কেবল ভারতকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতাম। আর নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপকে কয়টা গোল দেব সেই চিন্তা করতাম। এখন তো অবস্থা যেন একেবারেই উল্টে গেছে। আসলে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু আস্তে আস্তে এ রকম হয়ে গেছে।’ নিজের অর্জন সম্পর্কে মনি বলেন, জীবনে যা কিছু পেয়েছি ফুটবল থেকেই। সবসময়ই ফুটবলের সঙ্গে থাকতে চাই। ফুটবলের উন্নয়নে কেউ যদি স্মরণে আনে হাত বাড়াতে ভুল করব না।’ কাজী সালাহউদ্দিনকে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় বলে মনে করেন মনি। আর প্রয়াত কোচ গফুর বেলুচ, প্রয়াত আলী ইমাম এবং গোলাম সারোয়ার টিপুকে এখনও নিজের আত্মা মনে করেন। বেকেনবাওয়ার, জিকোকে ফুটবল আদর্শ এখনও তাকে টানে। সাবেক তারকা ফুটবলার মনি বর্তমানে মিরপুর ডিওএইচএস-এ থাকেন। তার স্ত্রীর নাম হোসনে আরা শাহীন। দুই সন্তানের জনক তিনি। ছেলের নাম সাকিউল ইসলাম সাদমান আর মেয়ের নাম সুমাইয়া ইসলাম মৌ।
×