
অশ্রুসজল নেইমারকে সান্ত¡না দিচ্ছেন সতীর্থ রাফিনহা ও সাফল্যের উল্লাস আর্জেন্টাইন তারকা মেসির
গোটা দুনিয়া অপেক্ষায় ছিল বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মহারণ দেখার। কিন্তু শুক্রবারের নাটকীয় রাতে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা ভাগ্যের পরশ পেলেও ভাগ্যবিধাতা বিমুখ করেছেন নেইমারের ব্রাজিলকে। তাইতো মহানাটকীয় আর রোমাঞ্চে ভরপুর রাতে ভাগ্যনির্ধারণী টাইব্রেকারে জিতে দিয়াগো ম্যারাডোনার দেশ পৌঁছে গেছে কাতার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। আর কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়ে কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খেয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে পেলের দেশের তারকাদের।
ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে শেষ আটের ম্যাচে নেইমারের রেকর্ড গোলে জয়ের পথেই ছিল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। কিন্তু অতিরিক্ত সময়ের শেষ দিকে গোল হজম করে বিপাকে পড়ে সেলেসাওরা। এরপর পেনাল্টি শুটআউটে ৪-২ গোলে হেরে কাঁদতে হয়েছে নেইমারদের। চোখের জলে আরেকবার শেষ হয়েছে তাদের স্বপ্নের হেক্সা জয়ের মিশন।
শুক্রবার রাতে নেইমার, ক্যাসেমিরো, বেকারদের চোখের জলে বিদায়ের একঘণ্টা পর অগ্নিপরীক্ষায় মাঠে নামে আর্জেন্টিনা। মহানাটকীয় এই ম্যাচে এক পর্যায়ে আলবিসেলেস্তারা দুই গোলে এগিয়ে যায়। কিন্তু শেষ সময়ের নাটকীয়তায় নির্ধারিত ৯০ মিনিটে ম্যাচ ২-২ গোলে সমতা থাকে। এরপর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে আর গোল না হলে ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের মতো আর্জেন্টিনা-হল্যান্ড ম্যাচও গড়ায় টাইব্রেকারে। যেখানে শেষ হাসি হেসেছে মেসিবাহিনী। আর তাই ম্যাচ শেষে আনন্দের আতিশয্যে উল্লাস করে কোচ লিওনেল স্কালোনির দল।
এখন তারা স্বপ্নপূরণের সন্নিকটে। ১৯৮৬ সালে সবশেষ দিয়াগো ম্যারাডোনার নৈপুণ্যে শিরোপা জয় করা আর্জেন্টিনা এই মুহূর্তে ৩৬ বছরের অপেক্ষা ঘোচানো থেকে দুই জয় দূরে। ডাচদের বিরুদ্ধে রুদ্ধশ্বাস জয়ে নির্ধারিত সময়ে আর্জেন্টিনার দুই গোলেই আছে মেসির ছোঁয়া। প্রথম গোলটা মলিনাকে দিয়ে করানোর পর পেনাল্টি থেকে নিজেই গোল করেন খুদে জাদুকর। সেখানেই শেষ নয়।
দুই গোলের লিড খুইয়ে আর্জেন্টিনাকে যখন যেতে হলো পেনাল্টি শুটআউটে, সেখানেও দলের প্রথম গোলটা আসে মেসির পা থেকেই। ঠাণ্ডা মাথায় নেয়া পেনাল্টি থেকে আর্জেন্টিনা যায় এগিয়ে। শেষমেশ দারুণ জয়ে সেমি কনফার্ম করে আলবিসেলেস্তারা। মজার বিষয়, এই ম্যাচেও মেসি বনে গেছেন ম্যাচসেরা খেলোয়াড়। এই মুহূর্তে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সব থেকে বেশিবার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ এর পুরস্কার মেসির দখলে। তিনি ম্যাচ সেরা হয়েছেন ৯ বার। এবারের বিশ্বকাপেও এখন পর্যন্ত সবার চেয়ে বেশি ম্যাচসেরা হয়েছেন এলএমটেন।
মেসিদের এমন সফলতার দিনে পৃথিবীতে নেই আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ফুটবলার দিয়াগো ম্যারাডোনা। দুই বছর আগেই তিনি পাড়ি দিয়েছেন পারাপারের দেশে। অর্থাৎ ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর এটিই আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ। ম্যারাডোনাকে ছাড়া প্রথম বিশ্বকাপে অনেকেই মিস করছেন প্রয়াত এ কিংবদন্তিকে। কিন্তু ব্যতিক্রম মেসি। কারণ রেকর্ড সর্বোচ্চ ছয়বারের ফিফা সেরা ও সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী তারকা মনে করেন স্বর্গ থেকেই তাদের সঙ্গে আছেন ম্যারাডোনা।
মেসির বিশ্বাস, স্বর্গ থেকেই তাদের সাফল্য উপভোগ করছেন আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর। শেষ আটে রোমাঞ্চকর জয়ের পর এমন বলেছেন ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে খেলা এই সুপারস্টার। স্বদেশী কিংবদন্তিকে স্মরণ করে আবেগতাড়িত মেসি বলেন, ‘ম্যারাডোনা স্বর্গ থেকে আমাদের দেখছেন। তিনি আমাদের প্রেরণা দিচ্ছেন। আমি সত্যিই আশা করি এটা শেষ পর্যন্ত থাকবে।’
টাইব্রেকারে শেষ মুহূর্তের টানটান উত্তেজনা প্রসঙ্গে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক বলেন, ‘যখন লাউটারো মার্টিনেজ গোল করল এবং আমরা সেমিফাইনাল নিশ্চিত করলাম সেটা বেশ উপভোগ্য ছিল। সে আমাদের বুক থেকে ওজন নামিয়ে দিয়েছে। ম্যাচটা বেশ কঠিন ছিল। শুরু থেকেই বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। আমরা জানতাম এভাবেই ম্যাচটা খেলতে হবে। ডাচ খেলোয়াড়রা লং বলে আমাদের কঠিন পরীক্ষা নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা ড্র করে আমাদের ভুগিয়েছে। কিন্তু আমরা নিজেদের স্থির রেখে ঠিকই সেমিফাইনালে পৌঁছে গেছি যা আমরা শুরু থেকেই চেয়েছিলাম।’
অন্যদিকে ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, এটাই হয়তো তার শেষ বিশ্বকাপ। ক্রোয়েশিয়ার কাছে অপ্রত্যাশিত হারের পরও একই ইঙ্গিত দিয়েছেন পিএসজিতে খেলা এই তারকা। তবে এখনই অবসর নিবেন কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলেননি ৩০ বছর বয়সী নেইমার, ‘আমি ব্রাজিল দলের জন্য দরজা বন্ধ করছি না। তবে শতভাগ নিশ্চয়তা দিচ্ছি না যে আমি ফিরব।
আমার ও জাতীয় দলের জন্য সঠিক কি হবে, তা নিয়ে আমাকে আরও কিছুটা ভাবতে হবে।’ নিজ দেশ হেরে গেলেও ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেছেন নেইমার। অতিরিক্ত সময়ে গোল করে দলকে প্রায় জিতিয়েই দিচ্ছিলেন। এই গোলে ম্যাচ না জিতলেও অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করেছেন তিনি। ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে কিংবদন্তি পেলের করা ৭৭ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন নেইমার।
মরুর বুকে ফ্রান্স, আর্জেন্টিনার সঙ্গে শিরোপা সম্ভাবনায় একই সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছিল ব্রাজিলের নাম। কারও কারও চোখে টপ ফেভারিট ছিল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে শেষ আটেই থমকে গেছে তাদের পথচলা। নেইমার-রিচার্লিসনদের এই বিদায় মানতে পারছেন না ফুটবল দুনিয়ায় কোটি কোটি ভক্ত-সমর্থকরা।
সবশেষ ২০০২ সালে বিশ্বকাপ জেতা ব্রাজিল এ নিয়ে টানা দ্বিতীয়বার বৈশ্বিক আসরের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে। ২০১৪ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলার আগে ২০০৬ ও ২০১০ সালেও শেষ আটে পথচলা থেমে গিয়েছিল ব্রাজিলের। গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচ জিতে শেষ ষোলো নিশ্চিত করা ব্রাজিল শেষ ম্যাচে বিশ্রাম দেয় প্রথম পছন্দের প্রায় সবাইকে। ক্যামেরুনের বিরুদ্ধে ওই ম্যাচে হেরে গেলেও শেষ ষোলোয় দক্ষিণ কোরিয়াকে উড়িয়ে দিয়ে প্রত্যাশার পারদ আরও উঁচুতে নিয়ে যান নেইমার-ক্যাসেমিরোরা।
শেষ আটেও একের পর এক আক্রমণে ক্রোয়েশিয়াকে চাপে রাখে ব্রাজিল। কিন্তু নিয়তির কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে তাদের। এই হার ফুটবল ছাপিয়ে দেশ হিসেবেও ব্রাজিলের জন্য বড় হতাশার। কোভিড মহামারির ধাক্কা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নাজুক অর্থনীতির মধ্য দিয়ে যাওয়া ফুটবলপাগল দেশটি আশায় বুক বেঁধেছিল, বিশ্বকাপ জিতে তাদের মুখে হাসি ফোটাবেন নেইমাররা। কিন্তু আরও একবার স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় পুড়তে হয়েছে তাদের। ম্যাচ শেষে তাই ব্রাজিলিয়ান ভক্তদের মাঝে চলছে শোকের মাতম। আর অঝোরে কেঁদে চলেছেন নেইমাররা।