ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩০ জুন ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

প্রয়াত ভাইকে গোল উৎসর্গ ঋতুপর্ণার

স্পোর্টস রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:০১, ২৯ জুন ২০২৫

প্রয়াত ভাইকে গোল উৎসর্গ ঋতুপর্ণার

প্রয়াত ছোট ভাই পার্বণের সঙ্গে ঋতুপর্ণা চাকমা

এএফসি নারী এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাহরাইনের বিরুদ্ধে চোখ ধাঁধানো গোল করে সেটি প্রয়াত ছোট ভাইকে উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের অন্যতম সেরা তারকা ঋতুপর্ণা চাকমা। রবিবার মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে ‘সি’ গ্রুপের ম্যাচে বাহরাইনকে নিয়ে ছেলেখেলা করেন বাংলার মেয়েরা। ম্যাচের ১৫ মিনিটে ডি বক্সের মধ্যে ঢুকে বাঁ পায়ের দর্শনীয় বুলেট শটে জাল কাঁপান ঋতুপর্ণা। গোলের পর আকশের দিকে দু’হাত প্রসারিত করেন সাফের সেরা এই তারকা। তখনই বোঝা গিয়েছিল তিনি প্রয়াত ভাইকে স্মরণ করছেন। 
ম্যাচের মধ্য বিরতিতেই ঋতুপর্ণা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আজ (২৯ জুন) আমার ছোট ভাইয়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশের হয়ে এই গোলটি আমার ভাইকে উৎসর্গ করলাম।’ সব সময় ¯িœগ্ধ ঋতুপর্ণা চাকমার স্নিগ্ধ হাসিটা সংক্রামকের মতো। এই মিষ্টি হাসি যে কারও মন খারাপের বেসুরো রংটা ভুলিয়ে দিতে বাধ্য। অথচ সেই ঋতুই মনের মধ্যে একটা দুঃখ বয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ।

তার মিষ্টি হাসির পেছনে কতটা কষ্ট লুকানো, সেটা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। ফুটবল খেলে সেই দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করেন। ইয়াঙ্গুনে যখন এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাহরাইনের বিপক্ষে মাঠে নামেন নিশ্চয় মনের ভেতরের পুষে রাখা যন্ত্রণাটা ফুটবলের আনন্দে ভুলতে চাইবেন। সেটাই তিনি করেছেন গোলের পর ভাইকে স্মরণ করে। 
২০২২ সালের ২৯ জুন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান ঋতুপর্ণার ছোট ভাই পার্বণ। যাকে আদর করে সিজি নামে ডাকতেন। ভাই হারানোর শোক কাটানো বড়োই কষ্ট ঋতুপর্ণার। সেই কষ্ট ভুলেই মাঠে নামেন। নিজের ফেসবুক পেজে ভাইয়ের স্মৃতি মনে করে একটা পোস্ট দিয়েছেন তিনি। যেখানে লিখেছেন, ‘আজ (২৯ জুন) তোর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তিন বছর হয়ে গেল তুই আমাদের ছেড়ে চলে গেছিস। সিজি তোকে বড্ড ভালোবাসি রে।

তোকে ভীষণ মিস করি।’ এরপর লিখেছেন, ‘আমার ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য সবাই প্রার্থনা করবেন।’ ঋতুপর্ণার বাবা ব্রজবাসী চাকমা ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছেন ২০১৫ সালে। বড় তিন বোনÑভারতী চাকমা, পামপি চাকমা ও পুতুলি চাকমার বিয়ে হয়ে গেছে। চার বোনের এক ভাই হওয়ায় সবচেয়ে আদরের ছিলেন পার্বণ। সেই আদরের ভাইকে হারিয়ে তখন প্রচ- ভেঙে পড়েন ঋতুপর্ণা।
পার্বণের দুই বছরের বড় ঋতুপর্ণা। পিঠেপিঠি ভাই-বোন হওয়ায় দুজনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। ২০১৭ সালে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ডাক পাওয়ার পর থেকে ঋতুপর্ণার সব ম্যাচ দেখেছেন পার্বণ। সবশেষ সাফে নেপালের কাঠমান্ডুতে পাকিস্তানের বিপক্ষে গোলের পর তাই সবার আগে ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল ঋতুপর্ণার। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ভাইকে কখনো ভুলতে পারি না।

প্রতি সেকেন্ডে মনে পড়ে। মনে হয় এখনো আমার পাশে আছে ও। গোল করার পর অনেক কেঁদেছি। মাঠে নামার আগে একটা জেদ ছিল, যেভাবেই হোক গোল পেতে হবে। ভাইকেই গোলটা উৎসর্গ করেছি। ঋতুপর্ণার কণ্ঠে সব সময়ই ঝরে আফসোস, ‘যদি গোলটা দেখত ভাই, ম্যাচ শেষেই ফোন দিত। অনূর্ধ্ব-১৯ সাফের পর বলেছিল, ‘দিদি, তুই তো ভাইরাল হয়ে গেছিস। সেলিব্রিটি হয়ে গেছিস।’
ঋতুপর্ণার সঙ্গে শেষবার পার্বণের কথা হয় ২০২২ সালের ২৮ জুন। ২৩ ও ২৬ জুন মালয়েশিয়ার বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচ শেষ হওয়ার পর জাতীয় দলের ক্যাম্প ছুটি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। ঋতুপর্ণা ২৯ জুন রাঙ্গামাটির উদ্দেশে ঢাকা থেকে বাসে রওনা দেন। সেদিন কেন জানি অজানা আশঙ্কা মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল তার, ‘ও সাধারণত আমাকে কম ফোন করে। সেদিন ফোন করে বলেছিল, ‘দিদি, তুই কবে আসবি?

দুই ভাই-বোনের এক সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য পরদিন বাসের টিকিট কাটেন। বাসে বসে কেমন যেন অস্থির লাগছিল ঋতুপর্ণার। আগের রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন। রুমমেট তহুরা খাতুনকে ক্যাম্প ছেড়ে আসার আগে বলেছিলেন, ক্ষমা করে দিস। ঋতুপর্ণা যখন বাড়ির পথে, দুর্ঘটনাটা ঘটে তখন। কিন্তু পথের মধ্যে থাকায় তাকে দুঃসংবাদ জানানো হয়নি। বাড়িতে গিয়ে জানতে পারেন নির্মম সত্য।

×