ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

মনি হায়দার

বাংলা সাহিত্যের অনির্বাণ জগত ॥ মুক্তিযুদ্ধের গল্প

প্রকাশিত: ০০:৫২, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১

বাংলা সাহিত্যের অনির্বাণ জগত ॥ মুক্তিযুদ্ধের গল্প

১৯৭১ সালে দখলদার হায়েনা পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী, ব্যতিক্রম হাতে গোনা আত্মপ্রতারক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ছাড়া, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে মাঠেঘাটে-বাড়িতে-গ্রামে-গঞ্জে-থানায়- মহকুমায়-জেলা ও রাজধানী ঘিরে, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে। ত্রিশ লাখ বাঙালী দিয়েছে প্রাণ পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকার-জামায়াতে ইসলামী, আলবদরদের হাতে। প্রায় পাঁচ লাখ নারী বিসর্জন দিয়েছেন পবিত্র সম্ভম। খুব সহজেই লিখলাম- হারিয়েছেন পবিত্র সম্ভ্রম কিন্তু একবার গভীর ধ্যানের সঙ্গে দেখলে, বোঝা যাবে কত পাশবিক বেদনা আর সব হারানোর বিষাক্ত সময় পার করেছেন, সেই মহত্তম নারীরা। বাংলাদেশ মাত্র আটষট্টি হাজার বর্গমাইলের ছোট দেশ। এই ছোট দেশটাজুড়ে পাকিস্তানী হার্মাদ সৈন্যরা এমন কোন নৃশংস অপরাধ নাই, যা ওরা সংঘটিত করে নাই। ১৯৭১ সালে বাংলা পথে মাঠে ঘাটে পাকিস্তানীরা বিচিত্র কায়দায় বাঙালী হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের কৌশলে মেতে উঠেছিল। সেই সব অব্যক্ত, ইতিহাসে যা লেখা হয়নি- বা কখনও লেখা হবে না- অকথিত বেদনা মথিত ঘটনা নিয়ে গল্প লিখেছেন, বাংলার অসামান্য গল্পকাররা। বিস্ময়কর ঘটনা গল্পের ইতিহাসে, পৃথিবী জুড়ে- মুক্তিযুদ্ধের গল্প। আমি ঠিক জানি না, আলজিরিয়ার গল্পকাররা- ভিয়েতনামের গল্পকাররা, দক্ষিণ কোরিয়ার গল্পকাররা- মুক্তিযুদ্ধের বা স্বাধীনতার গল্প নামে বিশেষ কোন গল্পের জাদুরবাক্স খুলেছে কি না! কারণ, ওই সব দেশের জনগণও বিদেশী আগ্রাসন আর সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশে মুক্তিযদ্ধের গল্প- আলাদা ব্যঞ্জনা, অন্যরকম গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এই অনন্য অসাধারণ প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন মহত্তম গল্পকাররা। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গল্প বাংলাদেশে কোন গল্পকার লিখেছিলেন, আজ গবেষণার অনুষঙ্গ। আমরা অনুমান করতে পারি- শওকত ওসমান, শওকত আলীদের হাতে প্রথম মুক্তিযুদ্ধের গল্প প্রাণ পেতে পারে। অবশ্য প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন, কলকাতায়, মুক্তধারা প্রকাশনার আধিকারিক চিত্তরঞ্জন সাহা নির্বাসিত লেখকদের একত্র করে একটি বই প্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন হচ্ছে- মুক্তধারা প্রকাশিত আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘রক্তাক্ত বাংলা’। যাই হোক- বাংলাদেশের প্রকাশনা তো শুরু হলো যুদ্ধকালে, একটি যুদ্ধরত জাতির জন্য এই ঘটনা কম গৌরবের নয়। যুদ্ধ শেষে নাগরিকরা, লেখকরা ক্লান্ত থাকে, গভীর বিশ্রামে যায়। কিন্ত ব্যতিক্রম বাংলাাদেশের গল্পকাররা। বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে রক্তাক্ত আখরে লিখতে শুরু করলেন গল্প। যুদ্ধের মাঠ থেকে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে লিখতে শুরু করলেন দাবানল গল্প, প্রেমের গল্প, সব হারানোর গল্প। গল্পগুলো হয়ে উঠল বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর্তি ও আর্তনাদের মানচিত্র, অর্জনের বিজয় স্মারক। গল্পের জগতকে গল্পকাররা রঙিন করে তুললেন বিচিত্র আখ্যান অনুভবের নির্যাস ও প্রেরণায়। সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, শওকত ওসমান, শওকত আলী, সেলিনা হোসেন, আনোয়ারা সৈয়দ হক, রাহাত খান, আমজাদ হোসেন, হাসনাত আবদুল হাই, ইমদাদুল হক মিলন, মাহবুব সাদিক, মঞ্জু সরকার, আবিদ আনোয়ার, মইনুল আহসান সাবের, ইসাহাক খান, পূরবী বসু, জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, রিজিয়া রহমান, রশীদ হায়দার, মোহিত কামাল, হরিশংকর জলদাশ, রফিকুর রশীদ থেকে তরুণ প্রজন্মের অনেকে ধারাবাহিকতার বিম্বিত রূপরেখায় বিচিত্র অধ্যয়নে মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখে চলেছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ কেবল বাংলা সাহিত্যের ভা-ারে নয়, বিশ^সাহিত্যের ভা-ারে নতুন অভিনব একটা প্রকরণ যুক্ত করেছে। বাংলাদেশের বাঙালী হিসেবে এই যুক্ততার জন্য আমরা আনন্দ এবং গৌরব অনুভব করতে পারি। ‘সংশপ্তক’ গল্প লিখেছেন নাসরীন মুস্তাফা। বাংলাদেশ যদিও স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পৃথিবীর মানচিত্রে, কিন্ত বাঙালী জাতি সম্প্রদায় হিসেবে খুবই আত্মপ্রকতারক। নিজের সঙ্গে লড়াইয়ের ফাঁদ রচনায় বাঙালী খুব দক্ষ, সেই ফাঁদ যতই কদর্য হোক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের করাল গ্রাস থেকে স্বাধীনতা অর্জন করলেও কিছু বাঙালী স্বাধীনতা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলে, পরাজিত মনোভাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুকে নির্মম হত্যার পর রাজনীতির মাঠে যে বিপরীত ¯্রােত প্রবাহিত হয়ে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটা চরম গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান ও চেয়ার দখল করে ‘স্বাধীনতা’ অমৃত শব্দটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল, তারই নিরঙ্কুশ সত্য প্রকাশ করে গল্পকার নাসরীন মুস্তাফার গল্প ‘সংশপ্তক’। ‘দশ বছর আগের একদিন’ গল্পে গল্পকার মুস্তাফিজ শফি তুলে ধরেন ক্ষত বিক্ষত বাংলার রূপান্তর। বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়লাভ করার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির জনককে হত্যার পর পুরো মানচিত্র জেনারেলদের হাত ধরে উল্টোপিঠে হাঁটতে শুরু করে। কেবল হাটে না, এক সময়ে দৌড়াতেও থাকে। ফলে, মাত্র পঁচিশ বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী, নরপিশাচ খুনীরা স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়। গাড়িতে ওঠে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের মাখা পতাকা। এক বেশ্যা রীরাঙ্গনা কিভাবে প্রতিবাদে পুনরায় ফেটে পড়েছিলেন, তারই বিশস্ত বয়ান রচনা করেন গল্পকার মুস্তাফিজ শফি ‘দশ বছর আগে একদিন গল্পে’। জহির রায়হান আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠতম সন্তান। ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি আমাদের চিরকালের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির মহাপুরুষ হয়ে আছেন। রচনা করেছেন গল্প ও উপন্যাস। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে ‘আরেক ফালগুন’ তো অর্জন করেছে বাইবেলের মর্যাদা। সেই মহাপুরুষকে আখ্যান করে গল্প রচনা করেছেন এই সময়ের স্বনিষ্ঠ গল্পকার স্বকৃত নোমান- ‘তেত্রিশ বছর’ ‘শত্রু’ হাসান আজিজুল হকের তিমির হননের অন্যমাত্রার মুক্তিযুদ্ধের গল্প। পড়তে গেলে বিষম লাগে, পড়া শেষ হলে গল্পের হলাহল বাস্তবতায় পাঠককে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয়। শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও একটা গুলি খরচ না করেই প্রতিশোধের জান্তবতায় কত কঠিনে হত্যা করা যায়, শত্রু গল্প আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়, গিলোটিনের ছায়ায়। সিজ ফায়ার সেলিনা হোসেনের জাগতিক চৈতন্যের নিঃশব্দ গ্রাসের এক গল্প। নুরউদ্দিনেরা যুদ্ধ করেছে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মাঠে, আজ জীবনের পড়ন্ত বেলায় পাথর তুলে জীবিকা অর্জন করলেও মুক্তিযোদ্ধা নূরউদ্দিন যখন বলেন, যুদ্ধ আমি সিজ ফায়ার করেছি, প্রযোজনে আবার নামব, তখন গোটা বাংলাদেশ জেগে ওঠে পরামানন্দে- মুক্তির সুমান বার্তায়। নবীন গল্পকার রোখসানা ইয়াসমীন মণি নিজের জন্ম এলাকা লাকসামের পটভূতিতে মুক্তিযোদ্ধা পিতার আয়নায় ‘অস্তিত্ব’ গল্প লেখেন তখন আশা আমাদের ফুরায় না, আমরা আশার স্রোতে হারিয়ে যাই না, বরং সঙ্গত হই- গল্পের বিচিত্র মানচিত্রে একাত্তরের রক্তপদাবলীর ইতিহাস এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ আমাদের জাগরণের নতুন অধ্যায়। ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ কেবল গল্প নয়, একাত্তরের মাঠের ক্রন্দনের চিৎকারের, অত্যাচারের, সংগ্রামের, লড়াইয়ের বিবিধ বিচিত্র অধ্যায়ের এবং আখ্যানের কারুকাজে প্রকাশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পাঠকের অন্তর্জমিনে। ফলে, গল্পের কারুশিল্পময়তার সঙ্গে যুদ্ধের এবং অর্জনের নানামাত্রিক প্রেক্ষিত পৌঁছে যায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হৃদ মাঝারে। বিশেষ করে বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির প্রসঙ্গ আসে, তখন নির্বাণ গল্পকারদের গল্প রচনার মধ্যে দিয়ে সত্য এবং ইতিহাস ছড়িয়ে যায় দিকে দিকে, জনে জনে এবং বিকৃতির পথ রোধ করে দাঁড়ায় অবিনাশী চেতনায় প্রজ্বলিত গল্পগুলো- আমরা যে গল্পগুলোকে লিখি- ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’। ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ মানে অনিঃশেষ আলো, মুক্তিযুদ্ধের গল্প মানে ইতিহাসের নামতা পাঠ, মুক্তিযুদ্ধের গল্প- মিথ্যার বিরুদ্ধে অজস্র সত্যের কোটি কোটি মিছিল। সেই মিছিলের ¯্রােতে হারিয়ে যায় সকল সর্বনাশ, কেবল দাঁড়িয়ে অনড় স্বাধীন সার্বভৌম অনন্য বাংলাদেশ।
×