
ভৌগোলিক প্রতিবেশ, নকশি কাঁথা ও শিল্পী পরিচিতি
নকশি কাঁথা ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন লোকশিল্প। গ্রামবাংলার পরিবারের বধূ ও কন্যারা তাদের পরিবারের প্রয়োজনে অর্থাৎ শীত নিবারণের জন্য, বিছানায় পাতানোর জন্য এবং শিশুদের গায়ে জড়ানো ও বিছানার জন্য এবং আত্মীয় পরিজনকে উপহার দেওয়ার জন্য নকশি কাঁথা তৈরি করা হতো। নকশি কাঁথার শিল্পীর সুখ-দুঃখ, আবেগ, প্রীতি ও স্বপ্ন-সাধ কাঁথার সেলাইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে গাঁথা থাকত।
শীলা বসাকের মূল্যবান মন্তব্য উল্লেখ করছি- ‘বাংলার লোকশিল্পের ধারায় নকশি কাঁথা এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রধর্মী সৃষ্টি। কাঁথা হল গ্রামীণ মানুষের অল্প শীতে ব্যবহার্য শারীরিক আচ্ছাদন স্বরূপ। সংস্কৃত কন্থাপ্রা. কংথা,বা কাঁথা শব্দটি উৎপত্তি। আবার কাঁথা শব্দটি বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হতে দেখা যায়, যেমন- কেঁথা, কেথা, ক্যাঁথা, কান্থা, ক্যাতা, কাথা, ক্যাঁতা ইত্যাদি। কাঁথাশিল্প একান্তই নারী-শিল্প।”১
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, জামালপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে নকশি কাঁথার সুনাম ছিল। এখনও সে সুনাম বজায় রয়েছে। বর্তমানে নতুন করে যুক্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও অঞ্চলে নকশি কাঁথা। নকশি কাঁথাশিল্পী হোসনে আরার২ সাফল্যের মধ্য দিয়ে।
ভৌগোলিক প্রতিবেশ, পরিপার্শ্ব এবং ধর্মীয়বোধ নকশি কাঁথায় যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নকশি কাঁথা তৈরি করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় আচার ও রীতির ছাপ রয়েছে। যেমন: মুসলিম নারীদের তৈরি নকশি কাঁথায় প্রাধান্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফুল, লতাপাতা, তারা, চাঁদ, জ্যামিত্যিক নকশা। আর হিন্দু সম্প্রদয়ের নারীদের নকশি কাঁথায় প্রাধান্য রয়েছে মন্দির, দেব-দেবী ও তাদের বাহনের মোটিফ।
ভৌগোলিক বিবেচনায় রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে লিক ফোঁড়ের যে ব্যবহার তা পদ্মা ও মহানন্দা নদীর ঢেউয়ের বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে। অবশ্য বরিশাল অঞ্চলেও নদীর প্রাধান্যের কারণেই লিক ফোঁড়ের ব্যবহার রয়েছে। তবে নামকরণে পার্থক্য দেখা যায়। লিক ফোঁড়ের কাঁথাকে লিক কাঁথা না বলে বরিশালী কাঁথা বলা হয়। ময়মনসিংহ, জামালপুর যেহেতু বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ, তাই এ অঞ্চলের নকশি কাঁথায় গাছ ও লতাপাতার মোটিফ গুরুত্ব পায়।
নকশি কাঁথার শিল্পী মূলত নারীরা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের গৃহবধূরা এবং তাদের সাথে পরিবারের অন্যান্য মেয়েরা এক সাথে বসেও নকশি কাঁথা সেলাই করে। মাঠ পর্যায়ে গবেষণার দেখা গেছে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নারীরা গ্রাম বাংলার নকশি কাঁথা সেলাইয়ের শিল্পী। সাধারণত ২০ থেকে ২২ বছর বয়স থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী নারীরাই নকশি কাঁথা তৈরির সঙ্গে যুক্ত। আগের দিনে গার্হস্থ্য উপকরণ হিসেবে প্রায় প্রত্যেক বাড়ির নারীরা নকশি কাঁথা সেলাই করতেন। বর্তমানে নাগরিক চাহিদা বেড়েছে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে নকশি কাঁথার কদর বাড়ায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অঞ্চলভিত্তিক একাধিক নারী নকশি কাঁথার শিল্পী হিসেবে ঐতিহ্যের পুননির্মাণ করছেন। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের মাতোয়ারা বেগম, জামালপুর অঞ্চলের ইশমত আরা মুক্তা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও অঞ্চলের হোসনে আরার কথা। এরা প্রত্যেকই প্রত্যেকের অঞ্চলে মাস্টার আটিস্ট।
নকশি কাঁথার উপকরণ ও তৈরির প্রক্রিয়া
নকশি কাঁথা সেলাইয়ের উপকরণ সামান্য ও সহজলভ্য। প্রথমত বলা যায় এর উপকরণ মেয়েদের পরার পুরনো শাড়ি ও পুরুষদের পুরনো লুঙ্গি বা ধুতি এবং নতুন থান কাপড়। সেলাইয়ের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন আকৃতির সুঁই এবং নকশা করার জন্য বিভিন্ন রঙের সূতা। যেমন- সাদা, কালো, লাল, নীল, হলুদ, খয়েরি। এছাড়াও কাপড়ের ভাঁজ ঠিক রাখার জন্য কাঠ কয়লার আগুনভর্তি ঘট, যে ঘটের তলা অনেকটা চ্যাপটা, খেজুর কাঁটা প্রভৃতি।
কাঁথাশিল্পের ঐতিহ্য বিকশিত হচ্ছে নকশি কাঁথাকে কেন্দ্র করে। নকশি কাঁথার তৈরির জন্য প্রথমে প্রয়োজন ট্রেসিং পেপার। ট্রেসিংয়ের ওপর বিভিন্ন ধরনের নকশা তৈরি করা হয়। নকশা তৈরিতে প্রথমে কাঠপেন্সিল বা কলম দিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হয় বিভিন্ন ধরনের নকশা।
নকশা আঁকার পর যে কাপড় দিয়ে নকশি কাঁথা তৈরি করা হবে সেই কাপড় প্রয়োজন মতো মাঝ বরাবর কেটে নিয়ে বিছানো হয়। তারপর নকশা আঁকা ট্রেসিং কাপড়ে বসানো হয়। একটি পাত্রে প্রয়োজন মতো নীল রং, পাউডার ও কেরোসিন তেল একত্রে গোলানো হয়। গোলানো তরলকে একটি পরিষ্কার কাপড়ের টুকরোতে নিয়ে ট্রেসিং পেপারে কোমল হাতের স্পর্শে ঘষে ঘষে লেপ্টানো হয়। ট্রেসিং পেপার কাপড়ে ছাপ দেওয়ার পর শুকাতে হয়। নকশা করা কাপড়টি যতই শুকোবে ততোই নকশা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারপর টুকরো কাপড়ের মাঝখান সুঁইসুতায় জোড়া লাগানো হয়। কাঁথার নকশাটি স্পষ্ট করার জন্য অনেক সময় কলমে আঁচড় কাটা হয়। নকশা ধরে ধরে তারপর চলে সেলাই।
এ ক্ষেত্রে সেলাইয়ের ফোঁড় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফোঁড়ের যে বৈশিষ্ট্য তা থেকে নকশার বৈচিত্র্যও ফুটে ওঠে। ফোঁড়ের রয়েছে প্রকারভেদ। যেমন- লিক ফোঁড়, রানফোঁড়, চেন ফোঁড়, ডবল রান ফোঁড়, ডারনিং ফোঁড়, বেঁকি ফোঁড়, ডাল ফোঁড়, বখেয়া ফোঁড়, দোরোখা ফোঁড় ক্রস ফোঁড়, জালি ফোঁড়, বোতামঘর ফোঁড়, ভরাট ফোঁড়, হলবিন ফোঁড়, সাটিন ফোঁড়, চাটাই বা পাটি ফোঁড়, হেরিংবোন ফোঁড় প্রভৃতি।
জামদানি শাড়ির পাড় যেমন শাড়ির সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে তেমনি নকশি কাঁথার পাড়ও কাঁথার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে। একেক অঞ্চলে রয়েছে একেক ধরনের পাড়। যেমন- ময়মনসিংহে আনাজ তাগা, কলমি তাগা; ফরিদপুরে পানপাতা, সাগরের ঢেউ, শঙ্খলতা; যশোরে তাস পাইড়, লতা পাইড়; জামালপুরে করলাবীচি পাড়, মাছ কাঁটা তাগা, পাটি তাগা; কুষ্টিয়ায় বরফি তাগা পাড়, সজনে তাগা পাড়, কলমিলতা পাড়, পদ্ম পাড়, বেঁটফুল পাড়, কচু পাতা পাড় প্রভৃতি উল্লেখ্যযোগ্য। নকশি কাঁথার নামকরণেও রয়েছে বৈচিত্র্য। যেমন- সুজনি কাঁথা, ওয়াড় কাঁথা, বাচ্চার কাঁথা, আরশিলতা কাঁথা, রুমাল কাঁথা, আসন কাঁথা প্রভৃতি।
নকশি কাঁথার ব্যবহার
নকশি কাঁথার ব্যবহার নানা ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। পারিবারিকভাবে পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনরা ব্যবহার করেন। যা নিতান্তই নিজেদের প্রয়োজনে বলা যায়। এছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয়-আচার-অনুষ্ঠান এবং বাণিজ্যিকভিত্তিতে ব্যবহার হয়। তবে বিশেষভাবে নক্ষণীয় নকশি কাঁথার বৈশিষ্ট্য অনুসারেও এর ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন সুজনি কাঁথার ব্যবহার হয় শোয়ার ক্ষেত্রে বা অতিথিদের বসার ক্ষেত্রে। আসন কাঁথা ব্যবহার করা হয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বসার জন্য। লেপ কাঁথার ব্যবহার হয়ে থাকে শীতকালে গায়ে দিয়ে শীত নিবারণের জন্য। বেতন বা বায়তন কাঁথার ব্যবহার হয়ে থাকে মূল্যবান বই-খাতা বা জিনিসপত্র জড়িয়ে রাখার জন্য। এছাড়াও ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দেওয়ালে টানানো বা ঝুলানো কাঁথারও ব্যবহার রয়েছে।
আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নকশি কাঁথা
আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নকশি কাঁথা গুরুত্বপূর্ণ লোকশিল্প হয়ে উঠেছে। এমনটি হওয়ার অন্যতম কারণ, মানুষ তার ঐতিহ্যেকে ফিরে পেতে চায় রুচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। নকশি কাঁথা আধুনিক রুচিকে ধারণ করেছে তার শৈল্পিক নান্দনিক কৌশল ও রসে। আদি নকশার সাথে নতুন নতুন নকশা যুক্ত হচ্ছে নতুন কৌশল ও বিন্যাসে। এ কারণেই নকশি কাঁথার সৃষ্টি হয়েছে গ্রাম বাংলায় কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের সর্বত্র ও বিদেশেও সুগভীর বিস্তার ঘটেছে। নকশি কাঁথার শিল্পীরা যে স্তরের বা পর্যায়ের হোন না কেনো তারা তাদের মানসিকতার স্তর উন্নত করতে সমর্থ হয়েছেন অন্যের মানসিকতার বোঝাপড়ায়। বর্তমানে নকশি কাঁথার ব্যবহারকারী যেহেতু নগরেরও তাই শিল্পীদের দৃষ্টি থাকতে হয় ব্যবহারকারীর মুগ্ধতা ও মনোরঞ্জনে এমনকি ঐতিহ্যের প্রতিও। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর প্রকৃতির যে মোটিফগুলো আছে সেগুলোর ওপর শিল্পী তাঁর নিজের অনুভ‚তিকে স্থাপন করে লোকজ রীতিকে বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত করেন। লোকজরীতিও নাগরিক প্রতিবেশের ব্যবহারকারীকে নস্টালজিক করে তোলে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আসে রূপান্তর। রূপান্তরের ধারায় নকশি কাঁথা আপন মহিমায় জায়গা করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ের নকশি কাঁথার শিল্পী হোসনে আরা তাঁর উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন কন্যা আসমার মাধ্যমে।