
ছবি: প্রতীকী
তিল তিল করে বিবর্তনের পথে আমরা পেয়েছি একগুচ্ছ পরজীবী—উকুন, পিঁপড়ে, ফিতা কৃমির মতো রক্তচোষা প্রাণী। কিন্তু আধুনিক যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী পরজীবীটি আর কোনও জীবজন্তু নয়, বরং চকচকে কাচের পর্দা ঢাকা, হাতের মুঠোয় থাকা এক বস্তু—স্মার্টফোন।
অস্ট্রালেশিয়ান জার্নাল অব ফিলসফিতে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, স্মার্টফোন নিছক প্রযুক্তিপণ্য নয়—বরং এটি আমাদের সময়, মনোযোগ ও ব্যক্তিগত তথ্য শোষণ করে এমন এক আধুনিক পরজীবী, যা প্রযুক্তি কোম্পানি ও বিজ্ঞাপনদাতাদের স্বার্থে কাজ করে।
স্মার্টফোন কি সত্যিই পরজীবী?
বিবর্তনবিদদের মতে, পরজীবী হল এমন এক জীব, যা তার ‘হোস্ট’-এর দেহ বা জীবনে থেকে সুবিধা নেয়, বিনিময়ে হোস্টের ক্ষতি করে। যেমন উকুন কেবল মানুষের রক্ত পান করে বেঁচে থাকে, কিন্তু বিনিময়ে দেয় শুধুই যন্ত্রণাদায়ক চুলকানি।
ঠিক তেমনিভাবে স্মার্টফোনও আমাদের অনেক কাজের হলেও, সেটি আমাদের ঘুম কমায়, সম্পর্ক দুর্বল করে, মনমেজাজ খারাপ করে এবং এক ধরনের ডিজিটাল আসক্তি তৈরি করে। আমরা টেরও পাই না—কখন ফোনের গোল্লায় পড়েছি।
বন্ধুত্ব থেকে পরজীবিত্বে রূপান্তর
সব সহবাস সম্পর্কই পরজীবিত্ব নয়। যেমন, আমাদের অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া হোস্টের ক্ষতি না করে বরং হজম ও রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে—একে বলে মিউচুয়ালিজম বা পারস্পরিক উপকারিতা।
শুরুতে আমাদের সঙ্গে ফোনের সম্পর্কটাও এমনই ছিল—যোগাযোগ, দিকনির্দেশ, তথ্য খোঁজার সুবিধা। অনেকে একে মানুষের মস্তিষ্কের সম্প্রসারণ হিসেবেও দেখেছেন।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, গবেষকদের মতে, এই সম্পর্ক হয়ে উঠেছে একপাক্ষিক—ফোন ও অ্যাপ নির্মাতাদের লাভ হয়, আর মানুষ হয় আসক্ত, অবসন্ন ও নিয়ন্ত্রণহীন।
ডিজাইনেই আছে শোষণের ফাঁদ
সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাপগুলোর ডিজাইনই এমন যে তারা আমাদের বারবার স্ক্রল করতে, ক্লিক করতে ও আগ্রহ ধরে রাখতে বাধ্য করে। ব্যবহারকারীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন কনটেন্ট দেখানো হয়, যা আমাদের আরও বেশি সময় ধরে ফোনের দুনিয়ায় আটকে রাখে।
ফোন জানে আপনি ঘুমাতে চান বা সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে চান—কিন্তু সেই তথ্য ব্যবহার করে আরও বেশি সময় আপনাকে ফোনে বেঁধে রাখাই তার উদ্দেশ্য।
আমরা কি প্রতিরোধ করতে পারি?
প্রকৃতিতে অনেক সময় হোস্টরা পরজীবী নিয়ন্ত্রণ করে—যেমন প্রবাল প্রাচীরে বড় মাছেরা ‘ক্লিনার র্যাস’ মাছকে নিজেদের পরিষ্কার করতে দেয়, কিন্তু যখন সেই মাছ প্রতারণা করে কামড়ায়, তখন তারা শাস্তি দেয় বা পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। একেই বলে পুলিশিং।
তাহলে আমরা কি আমাদের ফোনের পরজীবীত্ব ঠেকাতে পারি?
গবেষণা বলছে, এতে দুটি বিষয় দরকার:
১. পরজীবীত্ব চিনে ফেলা
২. সেটি বন্ধ করতে পারার ক্ষমতা
কিন্তু সমস্যা হল, ফোন কোম্পানিগুলি এমনভাবে অ্যাপ ডিজাইন করে যে শোষণ গোপন থেকে যায়। উপরন্তু, ব্যাংকিং থেকে ছবি তোলা, নেভিগেশন থেকে স্বাস্থ্যপর্যবেক্ষণ—সব কাজেই আমরা ফোনের ওপর নির্ভরশীল।
সমাধান কি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে সম্ভব?
না, শুধু ব্যক্তিগত ‘ফোন না ধরার সংকল্প’ যথেষ্ট নয়। কারণ, ব্যবহারকারীরা তথ্য যুদ্ধে পিছিয়ে, আর বড় কোম্পানিগুলি আমাদের অভ্যাস নিয়ন্ত্রণে প্রায় অপরাজেয়।
অস্ট্রেলিয়ায় শিশু-কিশোরদের সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবের মতো আইনি ও সামাজিক পদক্ষেপই পারে এসব ডিজিটাল পরজীবীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে।
গবেষকরা বলছেন—অ্যাপের আসক্তিকর ফিচার, ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ ও বিক্রয়ের বিরুদ্ধে আইন করা দরকার।
স্মার্টফোন নিঃসন্দেহে আধুনিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু সেটি যদি একতরফাভাবে আমাদের সময়, মনোযোগ ও তথ্য শোষণ করে, তবে সেটি আর বন্ধু নয়—এক অনুপ্রবেশকারী পরজীবী।
সমাধান? সচেতনতা, প্রযুক্তিনির্ভরতা কমানো, ও সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।
সূত্র: দ্য কনভারসেশন।
রাকিব