
ছবিঃ জনকণ্ঠ
সাগরপারের জনপদ পটুয়াখালীর কলাপাড়ার রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবনমানের স্থায়ী উন্নয়নে সরকারিভাবে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন এমন পরিকল্পনা নিয়েছেন।
জীবনজীবিকার উন্নয়ন ছাড়াও তাঁদের কৃষ্টিকালচার সংরক্ষণে নেওয়া হয়েছে বৃহৎ পরিকল্পনা। এরই মধ্যে বেশকিছু বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে।
রাখাইনদের সৃষ্ট এই জনপদের এক সময়ের দাপুটে জনগোষ্ঠী আজ পরিণত হয়েছেন ক্ষয়িষ্ণু জাতিতে। এক সময়ে অঢেল বিত্তবৈভবসহ জমি-জমার মালিকানার প্রভাবশালী এই জনগোষ্ঠী এখন অধিকাংশরাই অতিদরিদ্রে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতি হারাতে বসেছেন। অবস্থা এমন হয়েছে, পারছেন না জীবিকার চাকা সচল রাখতে। যেন নিজ ভূমে পরবাসীতে পরিণত হয়েছেন। জমিজমা হারিয়ে অধিকাংশ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এমনকি রাখাইন পল্লীর দেবোত্তর সম্পত্তি থেকে শুরু তাঁদের প্রয়াতদের সৎকার করার শ্মশান পর্যন্ত দখল করা হয়েছে।
সাগরপারের অলঙ্কারখ্যাত এই জনগোষ্ঠীর গুটি কয়েক পরিবার ছাড়া অধিকাংশরাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। জমিজমার পাশাপাশি তাদের সৃষ্টিশৈলী তাঁত বুনন হারিয়ে গেছে। রাখাইন পল্লীতে নেই তাঁদের স্বকীয়তা। নিয়ন্ত্রিত খাস পুকুরগুলো হাতছাড়া হয়ে গেছে। এমনকি নিজস্ব ভাষা শেখার স্কুলগুলো পর্যন্ত নেই। তারপরও রাখাইনরা নিজেরা যেমন বেঁচে থাকার লড়াইয়ের পাশাপাশি তাদের কৃষ্টি-কালচার পালনে এখনও সচেষ্ট থাকছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলে নিজের সমর্থেও পাশাপাশি সরকারি বেসরকারি সহায়তায়।
বর্তমানে সরকারিভাবে তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পুরাকীর্তি সংরক্ষণে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখনও কলাপাড়ার এই জনপদে আসা পর্যটক-দর্শনার্থীরা রাখাইন পল্লীর জীর্ণদশার বৌদ্ধবিহার ও মঠ ঘুরে দেখেন। জেনে নেন এখানকার এক কালের দাপুটে রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবনশৈলী। তাঁদের সংস্কৃতি শুনতে কিংবা জানতে আগ্রহ নিয়ে বেড়াতে আসেন বহু জ্ঞানপিপাসু। সরকারিভাবে এই জনগোষ্ঠীকে ণৃতাত্তিক জনগোষ্ঠী বলা হচ্ছে। কিন্তু রাখাইনরা এটি মানতে নারাজ। তাদের সাফ কথা- তারা এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, এখানকার ২৮টি রাখাইনপল্লীর দরিদ্র রাখাইনদের জীবনমানের উন্নয়নে সরকারিভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কুয়াকাটায় রাখাইন মহিলা মার্কেটটির ( অসমাপ্ত) পশ্চিমদিকে দু’টি বহুতল ভবন করা হবে। কমপক্ষে তিনতলা। বাকি তিনদিকেও বহুতল মার্কেট করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যেখানে দরিদ্র রাখাইন নারী পুরুষদের ব্যবসা করা সুযোগ থাকবে। রাখাইন কালচারাল একাডেমির জীর্ণদশার ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এটিকে অপসারণ করে নতুনভাবে পার্টনারশিপের মাধ্যমে বহুতল ভবন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রাখাইন কালচারাল একাডেমী কাম গেস্টহাউস ভবন করা হবে। যেখানটায় রাখাইন কালচারাল প্রোগ্রাম হবে। বাকি অংশে গেস্ট হাউস থাকবে। যার আয় দিয়ে রাখাইনদের সংস্কৃতি চর্চা, লালনের পাশাপাশি ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলবে। দেশের অন্যতম বৃহৎ মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধবিহার এলাকায় রাখাইন জাদুঘরটি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।
লতাচাপলীর নয়াপাড়া রাখাইন পল্লীতে মাচান (টং) টাইপের দুইটি ঘর নির্মান কাজ চলমান রয়েছে। যেখানে রাখাইন ঐতিহ্য তুলে ধরা হবে। তাঁদের কৃষ্টি-কালচার সমুন্নত রেখেই করা হচ্ছে। সরকারি অর্থায়নে এটি করা হচ্ছে। ওখানটায় পর্যটকরা ইচ্ছা করলে রাখাইনদের অনুমতি স্বাপেক্ষ ভিজিট করতে পারবেন। রাত্রিযাপন করতে পারবেন। ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে ফটোশুট করার সুযোগ থাকছে। ক্রয় করতে পারবেন তাঁদের হাতে বোনা তাঁতপণ্য। সকল পর্যটকের জন্য এটি উন্মুক্ত থাকবে। পরিকল্পনা রয়েছে সকল রাখাইন গ্রামগুলোর নাম সংরক্ষণ করার। দখল হয়ে যাওয়া রাখাইন পল্লীর দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সর্বোপরি এসব আয়মুখি পরিকল্পনা যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের কাজ চলমান রয়েছে। একটি গঠণতন্ত্র তৈরির কাজও চলমান রয়েছে। কলাপাড়ার রাখাইনদের কল্যাণে একটি তহবিল গঠণ করার চুড়ান্ত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। জনাব রবিউল ইসলাম আশা পোষণ করেন, এই প্রকল্পগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে পারলে রাখাইন কল্যাণ তহবিলে বছরে অন্তত তিন কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। যার আয় দিয়ে তাঁদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষাসহ জীবন-মানের উন্নয়নে ব্যয় করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক দিয়ারা আমখোলা রাখাইন পল্লীর বাসীন্দা মংমেয়া জানান, এমনসব পদক্ষেপ নেওয়া হলে রাখাইন জনগোষ্ঠীর স্থায়ী উন্নয়নের একটি পথ হবে। এমন উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান। পাশাপাশি এই আদিবাসী নেতা তাদের শ্মশানগুলো উদ্ধারের পাশাপাশি তাঁদের নামের সঙ্গে সঙ্গতি রাখা গ্রামগুলোর নামকরণ সংরক্ষণ করার দাবি করেন। তার মতে শ্মশানগুলোর চারদিকে পিলার দেওয়া হোক। সকল পাড়ার দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধার করে বৌদ্ধবিহার ও মঠগুলো সংষ্কারের দাবি তার।
বাংলাদেশ জনশুমারি ও গৃহগণণা ২০২২ অনুসারে কলাপাড়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে মোট ৯১৬ জন। এর মধ্যে রাখাইনদের সংখ্যা বলা হয়েছে ৮২৫ জন। তবে এটি সঠিক নয় বলে রাখাইনদের দাবি। তাদের দেওয়া তথ্যমতে (কারিতাস বরিশাল অঞ্চলের আইডিপিডিসি প্রকল্পের জরিপ-২০২৪), কলাপাড়ায় ৩০৬টি রাখাইন পরিবার রয়েছে। যার মোট লোকসংখ্যা ১১৬৯ জন। এর মধ্যে ৫৯৩ জন পুরুষ এবং নারী ৫৭৬ জন। যেখানে ২১৭ জন শিশু রয়েছে। বর্তমানে রাখাইনদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি তাঁদের কৃষ্টি-কালচার সংরক্ষণে নেওয়া পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন সম্প্রদায়ের মানুষ।
আলীম