ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পৃথিবীর পাতালে পৌঁছানোর দুঃসাহসিক অভিযানেরর রহস্যময় ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৬ জুন ২০২৫

পৃথিবীর পাতালে পৌঁছানোর দুঃসাহসিক অভিযানেরর রহস্যময় ইতিহাস

ছবি: সংগৃহীত

“পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে যদি গর্ত খোঁড়া শুরু করি, তাহলে কি এক সময় অপর প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব?” — এই কৌতূহলী প্রশ্নটি অনেকের শৈশব কল্পনার অংশ। কিন্তু সেই ছেলেমানসী চিন্তাকে বাস্তবতার রূপ দিতে চেয়েছিলেন একদল সোভিয়েত বিজ্ঞানী। তারা শুরু করেছিলেন পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছানোর এক ব্যতিক্রমধর্মী ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা। এই উদ্যোগের নাম ছিল কোলা সুপারডিপ বোরহোল।

চাঁদের পর পাতালের লক্ষ্য
সময়টা ছিল ১৯৭০ সাল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন আমেরিকার চন্দ্র জয়ের প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের বৈজ্ঞানিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে মরিয়া। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, “ওরা আকাশ জয় করেছে, আমরা পাতাল জয় করব।” পৃথিবীর গভীরে কী আছে তা জানার আগ্রহ থেকেই ১৯৭০ সালের ২৪ মে শুরু হয় খননকাজ, রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোলা উপদ্বীপে।

মাটির তলার তিন স্তর
ভূতত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর অভ্যন্তর তিনটি স্তরে বিভক্ত — উপরের স্তর ‘ক্রাস্ট’, মাঝখানে ‘ম্যান্টল’ এবং একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে ‘কোর’। বিজ্ঞানীদের পরিকল্পনা ছিল যতদূর সম্ভব গর্ত খুঁড়ে ভূস্তরের গঠন, গঠনগত পার্থক্য, তাপমাত্রা এবং জীবাশ্ম উপাদান নিয়ে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করা।

প্রযুক্তির সঙ্গে লড়াই
প্রথমে ৯ ইঞ্চি ব্যাসের গর্ত দিয়ে শুরু হয় ড্রিলিং। ৭০০০ মিটার গভীরে পৌঁছানোর পর ড্রিলিং যন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। এরপর উন্নত প্রযুক্তির “ইউরাল ম্যাশ-১৫থা” ব্যবহার করে কাজ চালানো হয়। ১৯৮৪ সালে একবার ড্রিল স্ট্রিং ভেঙে গিয়ে কূপের মধ্যে আটকে যায়, কিন্তু বিজ্ঞানীরা থামেননি। বিকল্প শাখা গর্ত দিয়ে কাজ চালিয়ে যান। অবশেষে ১৯৮৯ সালে তারা ১২,২৬২ মিটার, অর্থাৎ প্রায় ১২.৩ কিলোমিটার গভীরে পৌঁছাতে সক্ষম হন — যা আজও মানুষের খোঁড়া সবচেয়ে গভীর গর্ত।

প্রতিকূল তাপমাত্রা ও সোভিয়েত পতন
বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন প্রতি কিলোমিটারে তাপমাত্রা ১১°C বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল প্রতি কিলোমিটারে ২৪°C পর্যন্ত বাড়ছে। ১২ কিলোমিটার গভীরে তাপমাত্রা দাঁড়ায় প্রায় ২২০°C, যা ড্রিলবিট গলিয়ে ফেলার মতো ভয়ংকর। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আর্থ-রাজনৈতিক সংকট। অবশেষে ১৯৯২ সালে খনন কাজ স্থগিত করা হয় এবং ২০০৮ সালে কূপটি পুরোপুরি সিলগালা করে দেওয়া হয়।

যেসব রহস্য উন্মোচিত হলো
কোলা প্রকল্প হয়তো পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেনি, কিন্তু এটি বিজ্ঞানকে দিয়েছে অসাধারণ কিছু তথ্য।

ভূস্তরের গঠন নিয়ে প্রচলিত তত্ত্বগুলোকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে।

এমন গভীরে পানির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে, যা সম্ভব ছিল না বলেই ধারণা করা হতো।

দুই বিলিয়ন বছর পুরনো ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যারা ভয়ঙ্কর তাপ ও চাপে টিকে ছিল।

গভীর ভূগর্ভে পাওয়া গেছে উচ্চ ঘনত্বের মিথেন গ্যাস এবং এমনকি স্বর্ণের অস্তিত্ব।

"ওয়েল টু হেল" গুজব
এই প্রকল্প ঘিরে একটি ভয়াবহ গুজবও ছড়ায় — বলা হয়, বোরহোলে মাইক্রোফোন নামানো হয়েছিল যেখানে নরকের চিৎকার ধ্বনিত হয়েছিল। অনেকে একে “ওয়েল টু হেল” নামে অভিহিত করে। তবে বিজ্ঞানীরা পরিষ্কারভাবে জানান, বোরহোলে কোনো মাইক্রোফোন নামানো হয়নি এবং এই দাবির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটি শুধুই একটি এপ্রিল ফুলের গুজব।

পৃথিবীর গভীরতম স্থান
মানুষের খনন করা কোলা বোরহোল ১২ কিলোমিটার গভীর হলেও প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর স্থান হচ্ছে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ — প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে, যার গভীরতা প্রায় ১১,০০০ মিটার। তবে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে পৌঁছানো সহজ কারণ তা পানির নিচে, আর কোলা বোরহোলের যাত্রা ছিল শক্ত ভূভাগ ভেদ করে।

আজও অমীমাংসিত
পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছাতে হলে যেতে হবে প্রায় ৬,৩৭০ কিলোমিটার গভীরে — কোলার ১২ কিলোমিটার তার তুলনায় খুবই সামান্য। তা সত্ত্বেও এই খনন অভিযান আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, নিজেদের গ্রহ নিয়েও মানুষের জ্ঞানের কতটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

কোলা সুপারডিপ বোরহোল প্রকল্প আজ থেমে গেলেও তার রেখে যাওয়া তথ্য ও শিক্ষা পৃথিবীর গভীর রহস্য উন্মোচনের পথে এক বিরাট পদক্ষেপ।

ফরিদ 

×