ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

টেক দানব গুগল কি ভেঙে যাচ্ছে? বিশ্লেষকের মন্তব্য ঘিরে তোলপাড় প্রযুক্তি বিশ্বে

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ৪ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৩:৫৬, ৪ জুন ২০২৫

টেক দানব গুগল কি ভেঙে যাচ্ছে? বিশ্লেষকের মন্তব্য ঘিরে তোলপাড় প্রযুক্তি বিশ্বে

বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি দুনিয়ার অগ্রদূত গুগল এখন এক কঠিন মোড়ে দাঁড়িয়ে। একের পর এক প্রতিযোগিতা বিরোধী মামলায় হেরে যাওয়ার পর প্রশ্ন উঠছে গুগল নিজেই যদি নিজেদের ভেঙে ফেলে, তবে কেমন হয়? যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বেচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিষ্ঠানটির জন্য তা হতে পারে এক ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তন।

গুগলের বিরুদ্ধে চলছে বড় দুটি অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা। এর মধ্যে একটি মামলায় ইতোমধ্যেই রায় গিয়েছে গুগলের বিপক্ষে। ফেডারেল কর্তৃপক্ষ চাইছে গুগল যেন তার জনপ্রিয় কিছু ব্যবসা যেমন, ক্রোম ব্রাউজার, অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম এবং বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্ক বিক্রি করে দেয়। এর মধ্যেই গুগলের শেয়ারের দাম থমকে গেছে, আর সার্চ ব্যবসাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চাপে চ্যালেঞ্জের মুখে।

এই প্রেক্ষাপটে ডি.এ. ডেভিডসনের প্রযুক্তি বিশ্লেষক গিল লুরিয়া সম্প্রতি এক সাহসী প্রস্তাব দিয়েছেন গুগল যদি আদালতের চাপে নয়, বরং স্বেচ্ছায় নিজেকে কয়েকটি স্বতন্ত্র কোম্পানিতে ভাগ করে দেয়, তবে সেটা হতে পারে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

সিলিকন ভ্যালির সংস্কৃতি বরাবরই ছিল অপ্রচলিত পথে হাঁটার। সেখানে নিজেই নিজেকে ভাগ করা মানে প্রতিপক্ষ বা আদালতের চেয়ে এক কদম এগিয়ে থাকা। বিশ্লেষক লুরিয়া বলেন, আজকের গুগল এক ধরনের বিশাল কংগ্লোমারেটে পরিণত হয়েছে, যার অংশগুলো একে অপরের সঙ্গে খুব একটা সম্পর্কিত নয়। ইউটিউব, ওয়েমো, গুগল ক্লাউড, অ্যান্ড্রয়েড, গুগল অ্যাডস সবই আলাদা বাজারে কাজ করছে।

তিনি দাবি করেন, গুগলের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার হলেও, এই সব শাখা-উপশাখা যদি স্বাধীনভাবে ব্যবসা করত, তবে সম্মিলিতভাবে তাদের মূল্য দাঁড়াতে পারত ৩.৭ ট্রিলিয়নেরও বেশি। এর মানে, গুগল নিজেকে ভাগ করলে বিনিয়োগকারীদের জন্য তৈরি হতে পারে বিশাল মুনাফার সুযোগ।

লুরিয়া মনে করেন, এটি শুধু অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনের জন্যও দরজা খুলে দেবে। স্বাধীন কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হলে বাজারে আরও নতুন চিন্তা ও প্রযুক্তির উদ্ভব হতে পারে। ছোট প্রতিষ্ঠানে কাজ করা কর্মীদের জন্যও পদোন্নতি কিংবা নেতৃত্বের সুযোগ বেড়ে যাবে।

তবে তিনি এটাও স্বীকার করেছেন, গুগলের পরিচালনা পর্ষদ এই পথে যাবে এমন সম্ভাবনা এখনই খুব কম, মাত্র ১০ শতাংশের মতো। তবুও প্রতিদিন এই সম্ভাবনা একটু করে বাড়ছে।

আদালতে লড়াই, প্রতিদ্বন্দ্বীদের কৌশল এবং ইতিহাসের ভার
গুগল ইতোমধ্যে ওয়াশিংটনের একটি আদালতে যুক্তি দেখাচ্ছে যে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত ‘হালকা’। তবে বিচারক অমিত মেহতার রায়ে কী আসবে, তা নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে। আদালতের রায় গ্রীষ্মেই আসতে পারে, এরপর গুগল আপিল করবে বলে জানিয়েছে।

অন্যদিকে, গুগলের বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি নিয়ে আরেকটি মামলাতেও সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি হেরে গেছে। এইসব পরিস্থিতি দেখে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, গুগলের জন্য এখন স্বেচ্ছায় ভাঙার পথেই বেশি সুফল।

বিশ্ববিখ্যাত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ডিপওয়াটার অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের জিন মুনস্টার বলেন, “অনেক সময় বিভাজনের ফলে তেমন লাভ হয় না। কিন্তু গুগলের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। এখানে সত্যিকারের মূল্য বের হয়ে আসতে পারে।”

অতীতের উদাহরণ, বর্তমানের বাধা
যুক্তরাষ্ট্রে আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ১৯৮০-এর দশকে ন্যাশনাল ফোন কোম্পানি AT&T স্বেচ্ছায় নিজেকে ভেঙে সাতটি অংশে ভাগ করে দেয়। ফলে টেলিকম খাতে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল।

তবে গুগলের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এর শেয়ার মালিকানার গঠন এতটাই জটিল যে প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সার্গেই ব্রিনের সম্মতি ছাড়া বড় ধরনের কোন পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তারা নিজেরাই হয়তো এমন একটি ‘বোল্ড’ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন, যদি সেটি ভবিষ্যতের জন্য ভালো হয়।

টেকদুনিয়ার ‘ক্রুজ শিপ’ কি হবে ছোট ছোট ইয়টে?
প্রযুক্তি লবির একটি গ্রুপ ‘চেম্বার অব প্রগ্রেস’-এর সিইও অ্যাডাম কোভাসেভিচ বলেন, “গুগল এক বিশাল ক্রুজ শিপের মতো। ওরা চাইলেই নিজেকে চারটা ছোট ইয়টে ভাগ করে ফেলতে পারে। কিন্তু লাভ কী হবে? প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপল, অ্যামাজন, মেটাও তো বিশাল।”

তবুও অনেকের মতে, যদি বিভাজন প্রতিযোগিতা বাড়ায়, তাহলে বিজ্ঞাপনদাতারা কম খরচে ভালো সেবা পাবে। গুগলের অভ্যন্তরে কর্মীরাও নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ পাবে।

একজন অ্যান্টিট্রাস্ট আইনজীবী ব্যারি বারনেট বলেন, “গুগল ভেঙে গেলে শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যারা অবৈধ বাজারক্ষমতার সুবিধা পাচ্ছে।”

পরিণতি কী হতে পারে?
মাইক্রোসফটের অভিজ্ঞতাও এখানে আলোচনায় আসে। ২০০০ সালে মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধেও সরকার মামলায় জয়লাভ করেছিল। যদিও পরে আপিলে সেটি বাতিল হয়। তারপরও বিশ্লেষকেরা বলেন, সেই মামলার কারণে মাইক্রোসফট অনেকটা সময় প্রযুক্তি দুনিয়ার পরিবর্তন বুঝতে পারেনি এবং বাজারে পিছিয়ে পড়ে।

গুগল যদি এই একই পথে হাঁটে, তবে তার ফলও মাইক্রোসফটের মতোই হতে পারে। কিংবা তারা নিজেই ভিন্ন একটি ইতিহাস রচনা করতে পারে যেখানে এক সময়ের অজেয় প্রযুক্তি দানব নিজেই নিজেকে ভেঙে দিয়ে উদ্ভাবন, প্রতিযোগিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার নতুন যুগে প্রবেশ করে।

বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, এটা এক ধরনের ‘মেগা রিবুট’। প্রশ্ন একটাই,গুগল কি সাহস দেখাতে পারবে?

 

 

সূত্র:https://tinyurl.com/ynmjxwrr

আফরোজা

আরো পড়ুন  

×