ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ইতিহাস ভবিষ্যতকে পথ দেখায়

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

ইতিহাস ভবিষ্যতকে পথ দেখায়

প্রখ্যাত মার্কিন ইতিহাসনির্ভর প্রামাণ্য ছায়াছবি নির্মাতা কেন বার্নস গত ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের সমাপনী অনুষ্ঠানে এক লিখিত ভাষণ দেন। তাতে চলচিত্রকার হিসেবে তার জীবনবোধ, উপলব্ধি এবং বিভিন্ন সমস্যার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। এখানে তার উল্লেখযোগ্য অংশগুলো উল্লেখ করা হলো। আমার কাজ হচ্ছে ইতিহাসের স্মৃতিচারণ করা। আমাদের অতীতও যে শক্তি প্রয়োগ করে থাকে মানুষকে তা গল্প দিয়ে, কাহিনী দিয়ে, স্মৃতি দিয়ে, অনুভূতি দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়াই আমার কাজ- যাতে করে এখনকার ঘটনা প্রবাহকে আমরা আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারি। কয়েক দশক ধরে ইতিহাসভিত্তিক প্রামাণ্য ছায়াছবি নির্মাণ করে আমার এই উপলব্ধি ঘটেছে যে ইতিহাস স্থির কোন বিষয় নয়। এটা সুনির্দিষ্ট তারিখ ও বাস্তব ঘটনার সংগ্রহমাত্র নয়। ইতিহাস এক রহস্যময় ও অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার যোগ্য বিষয় যা সর্বক্ষণ পরিবর্তিত হচ্ছে। সেটা নতুন তথ্যের উদ্ভব হচ্ছে বলে নয় বরং আমাদের নিজেদের স্বার্থ, আবেগ ও অনুরক্তি বদলে যাচ্ছে বলে। প্রতিটি প্রজন্মই তার অতীতের সেই অংশ নতুন বলে আবিষ্কার করে, নতুন করে পরীক্ষা করে দেখে যা তার বর্তমানকে নতুন অর্থ, নতুন সম্ভাবনা ও নতুন শক্তি যোগায়। এখন আমাদের জন্য যে প্রশ্নটা এসে দাঁড়ায় তা হলো আমাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে আমরা কোন্টা বেছে নেব, কোন সুদূর অতীতের ঘটনা ও মৃত ব্যক্তিরা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার মতো প্রজ্ঞা যোগাবে? সেটা অস্তিত্বের প্রশ্নের অংশ। আমার এক ভাবপুরুষ সাংবাদিক টম ব্রোকাউ সম্প্রতি বলেছেন, আমরা যা করতে যাই তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা যা শিখি। আমি আমেরিকান ইতিহাসের বৃহত্তর পটভূমির মধ্যে ছোট ছোট মুহূর্তকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় আমার গোটা জীবন কাটিয়েছে। অতি কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের দেবদূতদেব খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি, মৃতদের জাগিয়ে তোলার এবং তাদের কাহিনী শোনার চেষ্টা করেছি। অতীত প্রায়শই এক আলকোজ্জ্বল ও সুস্পষ্ট দৃশ্য তুলে ধরে যেখান থেকে বর্তমান মুহূর্তগুলোকে দেখা যায়, বর্তমানের তীব্র আবেগগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া যায় ঠিক যখন সেগুলো আমাদের গ্রাস করে নিতে উদ্যত হয়। যে ইতিহাস আমরা জানি, সে কাহিনী আমাদের নিজেদের বলি সেটা অস্তিত্বগত উদ্বেগ দূর করে দেয়, আমাদের দ্রুত ধাবমান আয়ু অতিক্রম করে বাঁচার সুযোগ করে দেয় এবং জীবনকে মূল্য দিতে ও ভালবাসতে এবং কোন্টা গুরুত্বপূর্ণ সেই পার্থক্য টানতে দেয়। আর ব্যক্তিগত ও পেশাগত ইতিহাসের চর্চাই আমাদের কাছে এক ধরনের বিবেক হয়ে দাঁড়ায়। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে, ইতিহাসবিদ হিসেবে এবং একজন আমেরিকান হিসেবে আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবন, কথা ও দৃষ্টান্তের প্রতি আকর্ষিত হয়েছি। ১৫৮ বছর আগের কথা। লিঙ্কনের রাজনৈতিক দল তখন ছিল আনকোরা নতুন। মাত্র ৪ বছর আগে একটিমাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে দলটির জন্ম হয়েছিল এবং সেটা হলো দাসত্বের অসহনীয় ভ-ামির অবসান ঘটানো। সেই দাসত্ব তখনও বিরাজ করছিল এমন একটি দেশে যে দেশ কতিপয় অলঙ্ঘনীয় অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিল। লিঙ্কন তখন বলেছিলেন, যে পরিবার নিজেই বিভক্ত থাকে সে পরিবার দাঁড়াতে পারে না। সাড়ে চার বছর পর তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আমেরিকার ইতিহাসের ভয়াবহতম সঙ্কট, গৃহযুদ্ধের মধ্যে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার ঘর ছিল বিভক্ত। তথাপি তিনি বৃহত্তর ছবিটিও দেখতে পেয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘নীরব অতীতের আপ্তবাক্যগুলো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বর্তমানের কাছে অপ্রতুল। আমাদের এই সমস্যাটা নতুন। তাই আমাদের নতুন করে চিন্তা করতে ও নতুন করে কাজ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই দাসত্ববন্ধন থেকে মুক্ত হতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের দেশকে রক্ষা করতে পারব। আজ আমরা যে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে চলেছি তা সর্বশেষ প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাবে।’ তোমরা হলো সেই সর্বশেষ প্রজন্ম যার কথা লিঙ্কন রূপক অর্থে বলেছিলেন। তোমরা এখনও জান আর নাই জান এই ইউনিয়নকে রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের হাতে এসে বর্তেছে। লিঙ্কন যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন তা থেকে তোমাদের সময়কার সমস্যাটা সামান্য ভিন্ন। তথাপি তা একই রকমের কঠিন এবং এখন তোমাদের সেই সমস্যা মোকাবেলায় যোগ্যতার পরচয় দিতে হবে। সকলের কল্যাণবোধ অভিন্ন ত্যাগ স্বীকার, আস্থাবোধ যা হচ্ছে আমেরিকান জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। নীতিবর্জিত ইন্টারনেট সেই ক্ষয়টাকে বাড়িয়ে তুলছে, প্রসারিত করছে- যার ফলে সত্য প্রকাশ পেতে শুরু করার আগে মিথ্যাচার তিনবার পৃথিবীকে পাক খেয়ে আসে। তোমাদের গ্রাজুয়েশন শেষে নতুন জীবনে পদার্পণের অর্থাৎ তোমাদের ভবিষ্যতের প্রথম কয়েকটি মাস আমাদের প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
×