
আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমি ভূপৃষ্ঠের ওপর সুদৃঢ় পর্বতমালা তৈরি করেছি, যাতে তাদের নিয়ে তা দোল না খায় এবং তাতে তৈরি করেছি প্রশস্ত রাস্তা, যাতে তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারে। এবং আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ, কিন্তু এর নিদর্শনাবলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৩১) তাফসির : রহস্যঘেরা সৃষ্টি জগতের নানা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মহান আল্লাহ মানবসমাজকে প্রশ্ন করেন। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা পাহাড়ের রহস্যের কথা জানান।
সুউচ্চ পাহাড়-পর্বতের সৌন্দর্য যেমন মানুষকে মুগ্ধ করে, তেমনি তা সৃষ্টির রহস্যও খুবই অবাক করার মতো। মূলত ভূপৃষ্ঠের ভারসাম্য রক্ষায় পেরেক হিসেবে সুবিশাল পর্বতমালা সৃষ্টি করা হয়েছে। যেন পৃথিবী স্থির থাকে এবং এতে বসবাসে কারো সমস্যা না হয়।
পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে উঁচু আর ভারী স্থাপনার নাম পর্বত। তারই অনুজ পাহাড়। ঢেউ খেলানো সারিবদ্ধ পর্বতের মিছিল কোথাও আকাশের নীলে মিশে আছে। কোথাও লালিমার কোলে হারিয়েছে । সাদা, কালো, ঘোলাটে কতো রঙয়ের পাহাড়, কতো আকৃতির পর্বত।
এ সব প্রভুর বিস্ময়কর সৃষ্টি। অপার শক্তিমত্তার মহানিদর্শন। প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক। তাই কুরআনুল কারিম পাহাড়-পর্বত নিয়ে গবেষণা করতে মানুষকে উৎসাহিত করেছে।
ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং(তারা কি দৃষ্টিপাত করেনা)পর্বতমালার প্রতি কীভাবে তা দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা হয়েছে?’ (সুরা গাশিয়া:১৯) তাই এই নিবন্ধে ‘পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টিরহস্য’ নিয়ে কিঞ্চিত আলোকপাতের প্রয়াস চালানো হয়েছে-
পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষাকারী
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে অবিরাম ঘুরছে। যাকে বলে বার্ষিকগতি। এই ঘূর্ণনের বেগ বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে ঘন্টায় ১০,৭০০ কি:মি: প্রায়। আবার পৃথিবী নিজ অক্ষেও ঘুরছে অবিরত। যাকে বলে আহ্নিকগতি। তার বেগ ঘন্টায় ১৬৭০ কি:মি: প্রায়।
সুতরাং পাহাড়-পর্বত না থাকলে পৃথিবী ভারসাম্য হারাতো। জলে ভাসা খালি পাত্রের মতো নড়াচড়া করতো। ধ্বংস হতো সবকিছু। সামান্য ভূমিকম্পে তা আঁচ করা যায়। তাই আল্লাহতায়ালা জমিনের ওজন ঠিক রাখতে, নড়াচড়া বন্ধ করতে এতে স্থাপন করলেন ভারী পর্বতমালা। পেরেকের মত গেঁথে দিলেন বড় বড় পাহাড়।
ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি জমিনের ওপর সুদৃঢ় পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি, যাতে তাদের নিয়ে পৃথিবী ঝুঁকে না পড়ে...।’ (সুরা আম্বিয়া : ৩১)
সুরা নাবার ৭নং আয়াতে বলা হয়েছে,‘আমি কি পাহাড়গুলোকে পেরেকস্বরূপ সৃষ্টি করিনি?’ এ বিষয়ে রাসুল সা. বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা জমিন সৃষ্টি করলে তা নড়াচড়া শুরু করে। অত:পর এর ওপর পাহাড় স্থাপন করলে স্থিতিশীলতা আসে।’ (তিরমিজি : ৩২৯১)
নদী-নালার উৎপত্তিস্থল
পৃথিবীর প্রধান প্রধান যতো নদী আছে সবগুলোর উৎস প্রায় কোনো পর্বত কিংবা পাহাড়। মিষ্টি পানির স্বচ্ছ ঝরণাধারা পাহাড়েরই অবদান। সমুদ্রের পানি মেঘ হয়ে বর্ষিত হয় পাহাড়ে বরফ হয়ে আটকা পড়ে পর্বতে আর তা হতে গ্রীষ্মের তাপদাহে বরফখন্ড গলে গলে ক্ষয়ে ক্ষয়ে জন্ম নেয় নদ-নদী যা আবহমান কাল ধরে পৃথিবীর সকল প্রাণি আর উদ্ভিদরাজির পিপাসা নিবারণ করে বয়ে চলছে। কখনো কখনো পাহাড়-পর্বতের পাথরখন্ড ফেটেও নদী-নালা উৎপত্তি লাভ করে।
কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,‘আর নিশ্চয় পাথরের মধ্যে কিছু এমন আছে, যা থেকে নহর উৎসারিত হয়। আর কিছু আছে যা চূর্ণ হয়। ফলে তা থেকে পানি বের হয়।’ (সুরা বাকারা:৭৪)
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি
পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া যাবেনা। কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, নায়ক, পর্যটক, শিল্পী সবার ভাষা বা কলমে-চিত্রে পাহাড়ি রূপের বাহারি বর্ণনা রয়েছে। বিভিন্ন রঙ আর আকৃতির পর্বতমালা ছড়িয়ে আছে পৃথিবী জুড়ে।
তুরস্কের ‘রেইনবো’, ইরানের ‘আলাদগর’ কিংবা চীনের ‘ড্যানজিয়া’ পর্বতমালার কথা বলতে গেলে চোখে ভেসে ওঠে আকাশের রঙধনুর হৃদয়কাড়া রূপ। সাত রঙয়ের আস্ত রঙধনু যেন আছড়ে পড়েছে পর্বতের গায়।
এদের বলা হয় ‘রঙধনুর পাহাড়’ বা সাত রঙয়ের পর্বতমালা। প্রভুর কী কুদরত ক্যারিশমা। তাকে চেনা-জানার কতো কী রেখেছেন প্রকৃতির ভাঁজে ভাঁজে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি দেখো না! ...পাহাড়ে আছে বিভিন্ন বর্ণের গিরপথ বা খন্ড- সাদা, লাল আর নিকষ কালোর সমাহার?’ (সুরা ফাতির :২৭)
এ ছাড়াও গাছপালা ফুল-ফলসহ প্রাকৃতিক নানা নয়নাভিরাম দৃশ্যের দেখা মেলে পাহাড়ে। কুরআন তার বর্ণনা দিয়েছে এভাবে-‘পৃথিবীকে করেছি সুবিস্তৃত এবং তাতে সংস্থাপিত করেছি পর্বতমালা আর তাতে উদ্গত করেছি যাবতীয় সুদৃশ্য উদ্ভিদরাজি।’ (সুরা কাফ: ৭)
মানুষ ও প্রাণিদের আবাস্থল
মানব ইতিহারের সূচনা কাল থেকেই মানুষ পাহাড়ে বসবাস করে আসছে। শ্রীলঙ্কার ‘আদম পাহাড়’ তারই প্রমাণ বহন করে। ওপরে ঘর বানিয়ে কিংবা পাহাড় কেটে গর্ত করে বসবাসের প্রচলন আদিকাল হতেই রযেছে। আদ, সামুদসহ বেশ কিছু জাতি বা ব্যক্তিবর্গের পাহাড়ে বসবাসের কথা কুরআনে উল্লেখ হয়েছ।
সামুদ জাতি প্রসঙ্গে এসেছে -‘তারা পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করতো নিরাপদ বসবাসের জন্য।’ (সুরা আল হিজর: ৮২)
সে ধারা আজো অব্যাহত আছে। পৃথিবীর ৭০টি দেশের প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি এখনো পাহাড়ে বসবাস করে। বাংলাদেশের প্রায় ২৬টি ভাষাভাষীর ৪৫টি জাতিসত্তার ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি, যাদের সংখ্যা প্রায় ১ মিলিয়ন বা মোট জনসংখ্যার ০১ ভাগ -পাহাড়ে বসবাস করে। তাছাড়াও পশু-পাখি,কীট-পতঙ্গ ও গর্তে বসবাস করা বহু প্রাণির অভয়ারণ্য এই পাহাড়।
সুরা নাহলের ৬৮নং আয়াতে, আল্লাহতায়ালা মৌমাছিদের পাহাড়ে মৌচাক বানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। জিনজাতির আবস্থল হিসাবেও পাহাড়গুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মদীনার ‘ওয়াদি আল জিন বা জিনের পাহাড় তন্মধ্যে বিখ্যাত।
সম্পদের আধার আল্লাহতায়ালা পাহাড়গুলোতে বহু মূল্যবান প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ রেখে দিয়েছেন। বিচিত্র শিলাখন্ড, পাথর, কয়লা, লোহা, তামা, রুপা, স্বর্ণ ও লিথিয়ামের মতো দামি পদার্থসহ পারমানবিক শক্তির অন্যতম উৎস ইউরেনিয়ামেরও যথেষ্ট মজুদ তাতে রয়েছে গাছপালা, ফুল-ফল, তৃণলতা, শাক-সবজি, উন্নত মসলাদিসহ রকমারি ফসলে পরিপূর্ণ পাহাড়ের ভূমি।
কুরআনে এসেছে-‘জমিনের ওপরভাগে তিনি পর্বতমালা স্থাপন করেছেন এবং তাতে বরকত দিয়েছেন। (ফুসসিলাত:১০)
এছাড়াও বেশকিছু আয়াতে পাহাড়ি প্রকৃতির বর্ণনা এসেছে। সুরা নাজিয়াতের ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে- ‘এসব তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জীবজন্তুগুলো জীবনোপকরণের জন্য।’
ইবাদাতের নীরব ক্ষেত্র
দ্বীন রক্ষা ও দুনিয়ার কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে ইবাদাতের জন্য পাহাড়-পর্বত একটি নিরাপদ ও নীরব ক্ষেত্র। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত অত্যন্ত চমকপ্রদ ঘটনা ‘আসহাবে কাহাফ’ বা গুহাবাসীর ঘটনা। তারা তাদের ইমান রক্ষার জন্যেই মূলত পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
হযরত মুসা আ: তুর পর্বতে চল্লিশ দিন তাওরাত লাভের জন্য নীরবে সাধনা চালিয়ে ছিলেন। নবুয়ত প্রাপ্তির আগে আমাদের প্রিয় নবি সা: হেরা পর্বতের নিরিবিলি গুহায় একাকি ইবাদত করতেন ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। পরিশেষে নবুয়ত পেয়ে কুরআনের বাণী বুকে ধরে ঘরে ফিরেছিলেন। ফেতনার মুহুর্তে ইমান-আমল রক্ষার শ্রেষ্ঠতম স্থান হলো পাহাড়-পর্বত।
নবিজি সা: বলেন, ‘মানুষের ওপর এমন এক যুগ আসবে, যখন মুসলিমের জন্য শ্রেষ্ঠ সম্পদ হবে ভেঁড়া-ছাগল; তা নিয়েই পর্বত-শিখরে ও পানির জায়গাতে চলে যাবে; ফিতনা থেকে নিজ দ্বীন নিয়ে পলায়ন করবে।’ (বুখারী: ৩৬০০ )
আল্লাহর অনুগত সৃষ্টি পাহাড়-পর্বতগুলো আল্লাহর অনুগত সৃষ্টি। এরাও সর্বদা তাঁকে সেজদা করে । (সুরা হজ:১৮) হযরত দাউদ আ: এর সাথে সকাল-বিকাল আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করতো। (সুরা ছোয়াদ:১৮)
আল্লাহর ভয় এদের মাঝেও আছে। তাই পর্বতচূড়া হতে কখনো কখনো পাথর খন্ড খসে পড়ে জমিনের বুকে। (সুরা বাকারা:৭৪)
যতদিন আল্লাহর নির্দেশ থাকবে পৃথিবীকে সুরক্ষা দেয়ার ততদিনই তা দিয়ে যাবে। যখন পৃথিবী ধ্বংসের ডাক আসবে তখন পর্বতগুলো মাটি থেকে পৃথক হয়ে দৌড়াতে শুরু করবে। প্রবল কম্পন তুলবে পৃথিবীর বুকে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অস্তিত্ব হারাবে নিজে। হবে ধুনিত রঙিন পশমের মতো, উৎক্ষিপ্ত ধুলোবালি কিংবা মরীচিকার সদৃশ। (আল কুরআন)
Jahan