ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

সৌদি আরবের প্রাচীন নগরী মাদা’ইন সালেহ, নাবাতীয়দের হারানো রাজধানীর নিদর্শন

মোহাম্মদ সানাউল হক, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রিয়াদ

প্রকাশিত: ০৮:২০, ২৫ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৮:২৩, ২৫ জুন ২০২৫

সৌদি আরবের প্রাচীন নগরী মাদা’ইন সালেহ, নাবাতীয়দের হারানো রাজধানীর নিদর্শন

ছবি: জনকণ্ঠ

সৌদি আরবের বিস্তীর্ণ মরুভূমির বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন নগরীর নীরব সাক্ষী-মাদা’ইন সালেহ। আরবি নাম মাদা’ইন সালেহ-যার অর্থ ‘সালেহের নগরী’, ইতিহাসে এটি আল-হিজর বা হেগ্রা নামেও সমানভাবে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক মানচিত্রে এর অবস্থান আজ কেবল সৌদি আরবের নয়, সমগ্র আরব ইতিহাসের জন্যই অমূল্য।

 

 

মদিনা প্রদেশের আল-উলা সেক্টরে ছড়িয়ে থাকা এই প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা একসময় ছিল নাবাতীয় সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তের গর্ব ও বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে গড়ে ওঠা এই নগরী, পেত্রার জাঁকজমকের পরই নাবাতীয়দের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে। পাথর খোদাই করে নির্মিত সমাধি, প্রাসাদ এবং শিলা লিপি এখানে ছড়িয়ে আছে মরুর বুক জুড়ে।

এছাড়াও প্রতিটি স্থাপনা যেন প্রাচীন আরব বাণিজ্য পথ, ধর্মীয় রীতিনীতি ও নাবাতীয় শিল্পরুচির জীবন্ত দলিল। গবেষক ও পর্যটকদের কাছে এটি শুধু এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, বরং প্রাচীন সভ্যতার শৈল্পিকতা আর বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির এক অনন্য প্রমাণ। এখনো প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসেন এই বালুরাজ্যের নিস্তব্ধ সৌন্দর্য ও ইতিহাসের গোপন গল্প শোনার আশায়। 

মাদা’ইন সালেহের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় ১৯৭২ সালে, যখন সৌদি সরকার এই প্রাচীন নগরীকে রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ধাপে ধাপে এর অনন্য স্থাপত্য ও প্রাচীন নিদর্শনগুলো পুনরায় আবিষ্কৃত ও সংরক্ষিত হতে থাকে, যা পর্যটন এবং গবেষণার জন্য নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে। ২০০৮ সালে ইউনেস্কো মাদা’ইন সালেহকে সৌদি আরবের প্রথম বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করে, যা দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।

আজ এখানে পর্যটকদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে পাথর কেটে নির্মিত ১৩১টি সৌধ, বিস্তীর্ণ সমাধিক্ষেত্র ও দৃষ্টিনন্দন শিলালিপি খচিত সম্মুখভাগ। প্রতিটি স্তম্ভ আর খোদাই যেন হাজার বছরের ইতিহাসের পাতা থেকে শোনা কোনো মধুর প্রতিধ্বনি।

 

 

কালের বিবর্তনে এই নগরীর নাম বদলেছে বহুবার- মাদা’ইন সালেহ, (আল-হিজর, হেগ্রা) প্রতিটি নামের পেছনে আছে গভীর অর্থ আর ইতিহাস। আন্দালুসিয় পর্যটকদের ১৩৩৬ সালের লিপি থেকে এ নামের উল্লেখ মিলে। কোরআনেও এর উল্লেখ রয়েছে ছামুদ জনগোষ্ঠীর শহর হিসেবে, যাদের সম্পর্কে বলা হয় তারা মূর্তিপূজা করত এবং নবী সালেহ (আ.)-এর সতর্কবার্তা অমান্য করায় শাস্তি নেমে আসে।

‘আল-হিজর’, অর্থাৎ ‘পাথরের নগরী’— এই নামটি এসেছে এখানকার স্বতন্ত্র ভূপ্রকৃতি আর প্রাকৃতিক শিলাখণ্ডের কারণে। মরুভূমির বুকে ছড়িয়ে থাকা বিশালাকার পাথরখণ্ডগুলোর গায়ে নাবাতীয়দের জটিল খোদাই আর অনন্য স্থাপত্যশৈলী যেন মানুষের সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে প্রকৃতির অপরূপ মিলনের এক নিরব সাক্ষী।”

ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে সৌদি আরবের আল-উলা শহর থেকে মাত্র ২০ কিমি উত্তরে, মদিনা নগরী থেকে প্রায় ৪০০ কিমি উত্তর-পশ্চিমে এবং জর্ডানের পেত্রা নগরী থেকে প্রায় ৫০০ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থান এ নগরীর। হিজাজ পর্বতমালার পাদদেশের সমতল ভূমিতে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন জনপদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে মরুভূমির স্বাভাবিক শুষ্কতা, যা একে সযত্নে রক্ষা করেছে যুগের পর যুগ।

এখানকার পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রায় ২০ মিটার গভীর খাল এবং আশেপাশের বহুরূপী শিলাখণ্ড এ স্থানকে মরু অঞ্চলের এক প্রাকৃতিক শিল্পভাণ্ডারে পরিণত করেছে।
প্রাচীনকালে এখানে লিহাইয়ান্স নামে এক আরব রাজ্য ছিল, যা খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ থেকে ৪র্থ শতাব্দী পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ডিডানাইট নামেও পরিচিত এই রাজ্যের রাজধানী ছিল ডিডান, যা আজকের আল-উলা মরুদ্যান হিসেবে পরিচিত। পরে লিহাইয়ান জনগোষ্ঠী নাবাতীয়দের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নতুন পরিচয় পায়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাদা’ইন সালেহর নিকটে আথলেব পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা প্রাচীন চিত্র ও শিলালিপি লিহাইয়ান্সদের বাসস্থানের প্রমাণ বহন করছে। এ অঞ্চল প্রাকৃতিকভাবে উর্বর ও জলসমৃদ্ধ হওয়ায় প্রাচীন বাণিজ্যপথের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।

খ্রিস্টাব্দ ১০৬ সালে নাবাতীয় রাজ্য রোমান সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। হিজাজ অঞ্চলে রোমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে হেগ্রার বাণিজ্যিক গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। উত্তর থেকে আরব উপত্যকা হয়ে লোহিত সাগর পর্যন্ত নতুন বাণিজ্যপথ তৈরি হওয়ায় হেগ্রা ক্রমেই জনশূন্য হতে শুরু করে। ১৭৫–১৭৭ খ্রিস্টাব্দের রোমান লিপি আজো সেই ইতিহাসের প্রমাণ দেয়।

রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ইসলামের উত্থান পর্যন্ত হেগ্রার ইতিহাস আংশিক অজানা। তবে কিছু পর্যটক ও মনীষীর রচনায় জানা যায়, তখন এটি ধর্মীয় কাজ ও হজযাত্রীদের বিশ্রামের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে অটোমান শাসনের অধীনে আল-হিজরে একটি দুর্গ নির্মিত হয়, যা মক্কাগামী হজযাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত হতো। ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্থানীয় মানুষের শ্রদ্ধাবোধের কারণে এ স্থানের উপর ধর্মীয় অনুশাসন প্রভাব বিস্তার করে, যার ফলে এ অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক স্বীকৃতি পেতে বিলম্ব ঘটে।

মাদা’ইন সালেহর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর বিস্তৃত সমাধিক্ষেত্র। প্রায় ১৩.৪ কিমি দীর্ঘ এই ক্ষেত্র জুড়ে রয়েছে ১৩১টি নাবাতীয় খোদাই সৌধ, যার শিলালিপি নাবাতীয় রাজত্বের শৈল্পিক উৎকর্ষের নিদর্শন।

এ প্রাচীন স্থানে প্রায় দুই হাজারটি সৌধবিহীন সমাধি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যা আজও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের কাছে অতুলনীয় তথ্যভান্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সমাধিগুলো প্রাচীন সভ্যতার সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় রীতি ও শবদাহ প্রথার ওপর গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করে। সমতল ভূমির মধ্যবর্তী অংশে একসময় গড়ে উঠেছিল একটি সুসংগঠিত আবাসিক এলাকা, যা স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য মাটি এবং সূর্যের তাপে শুকানো ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। সময়ের ধারাবাহিক ক্ষয় ও প্রাকৃতিক প্রভাব সত্ত্বেও, সেই আবাসিক এলাকার ভগ্নাবশেষের কিছু অংশ এখনো অক্ষত থেকে ইতিহাসপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। প্রতিটি ভাঙা প্রাচীর, মাটির ইটের স্তূপ আর সংরক্ষিত ধ্বংসাবশেষ যেন প্রাচীনকালের মানুষের জীবনধারা ও স্থাপত্যশৈলীর এক নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”

এছাড়া, সেই সময়ে পানি সরবরাহের জন্য ছিল প্রায় ১৩০টি কূপ। প্রতিটি কূপের ব্যাস ছিল প্রায় ৪ থেকে ৭ মিটার, আর গড় গভীরতা প্রায় ২০ মিটার। পাথর খোদাই করে কিংবা কঠিন মাটি ভেঙে এই কূপগুলো খনন করা হয়েছিল, যা তখনকার মানুষের স্থাপত্য ও প্রকৌশল জ্ঞানকে তুলে ধরে।

শুষ্ক মরুভূমির কঠিন আবহাওয়া, পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তার অভাব এবং স্থানীয় জনগণের ধর্মীয় ভয়— এই সবকিছু মিলে প্রাচীন নগরীটিকে যুগের পর যুগ অক্ষত অবস্থায় টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। সৌদি আরবের প্রায় চার হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের মধ্যে মাদা’ইন সালেহ অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘সৌধের রাজধানী’ নামে পরিচিত।

আজ বিশ্বের পর্যটক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসানুরাগীদের কাছে এটি এক অনন্য বিস্ময়,  মরুর বুকে দাঁড়ানো এক নিঃশব্দ বাতিঘর, যা আজও প্রাচীন আরব সভ্যতার গৌরবময় অতীতের সাক্ষী হয়ে আছে।
 

ছামিয়া

×