ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হাজীরা কোরবানির মাংস কী করেন?

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ৫ জুন ২০২৫

হাজীরা কোরবানির মাংস কী করেন?

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা বর্ণ, ভাষার মানুষ আল্লাহর দরবারে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের এক পোশাকে মিলিত হয় আরাফাতের ময়দানে। হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে যমুনা নদীর তীরে পশু কোরবানি দেওয়া হয়। প্রতিবছর ২০ লাখেরও বেশি মানুষ হজ পালনের পরে ওয়াজিব কোরবানি দিয়ে থাকেন। তবে লাখ লাখ পশুর বিপুল পরিমাণ মাংস নিজেদের পুষ্টি বা আত্মীয়-স্বজনের মাঝে ভোগ করার বাইরে অনেকাংশে বিদেশেও নিয়ে যাওয়া হয় না, আর মিসকিন-দুঃস্থ মানুষের সংখ্যা ও এত বেশি নয় যা এই বিপুল মাংসের চাহিদা পূরণ করতে পারে। তাহলে এসব মাংসের পরিণতি কী?

এক সময় হাজীদের মধ্যে অনেকেই কোরবানির মাংসগুলো শুকিয়ে সংরক্ষণ করতেন বাড়ি নিয়ে যেতে। কেউ নিরুপায় হয়ে রাস্তার ধারে মাংস ফেলে দিতেন, আবার কেউ প্রক্রিয়াজাতকরণের অক্ষমতায় মাটিতে মাংস পুঁতে ফেলে দিতেন। যা ছিল অপচয়জনিত একটি বড় সমস্যা এবং পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর।

১৯৮৩ সালে সৌদি কর্তৃপক্ষ মক্কা, মিনা ও আশেপাশের এলাকার পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে কোরবানির মাংস কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই উদ্যোগ শুধু পরিবেশ রক্ষা করেই থেমে থাকেনি, বরং মুসলিম বিশ্বের ২৭ দেশের তিন কোটিরও বেশি মানুষের খাদ্য যোগানের এক অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়।

প্রকল্পটির নাম ‘ইউটিলাইজ ফর স্যাক্রিফিশিয়াল এনিমেল’, স্থানীয়ভাবে আদাহী নামেও পরিচিত। ২৫ বছর আগে মোয়াইসেমে একটি স্বয়ংক্রিয় কসাইখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে পরিচ্ছন্নতা, কসাই কর্মী ও প্রশাসকসহ ৪০ হাজারের বেশি কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন।

হজ মৌসুমে এখানে লাখ লাখ ভেড়া, গরু এবং উটের মাংস প্রক্রিয়াজাত করা হয়। শুধু মাংসই নয়, দিনে ৫০০ টন উৎসিষ্টাংশও প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই প্লান্ট সেগুলোকে সার হিসেবে রূপান্তরিত করে পরিবেশের ক্ষতি রোধ করে।

কোরবানির মাংস নিয়ম মেনে মসজিদুল হারামের আশেপাশের দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ শুরু হয়। এছাড়া পবিত্র ঈদুল আযহার প্রথম দিন থেকে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে এই মাংস পাঠানো হয়। মহররম মাসের প্রথম দিন সৌদি আরবে ২৫০টি দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে মাংস বিতরণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রকল্পটি মোট ১০টি সরকারি সংস্থা দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হয়।

হাজীরা চার উপায়ে পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন: নিজে হাটে গিয়ে কিনে, কোনো প্রবাসীর মাধ্যমে, আইডিবির কুপন কিনে, অথবা কোনো এজেন্সির মাধ্যমে। অনেক প্রবাসীও হজ মৌসুমে পশু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকেন এবং এজেন্সির মাধ্যমে কোরবানি কার্যক্রমে অংশ নেন। এজেন্সিগুলো হাজীদের ভাড়া বাড়িতে থাকা খাবারের সঙ্গেও মাংস পরিবেশন করে থাকে।

হাজীদের বড় অংশই আইডিবির উপর কোরবানির ব্যবস্থা ছেড়ে দেন, যার ফলে তারা সময় ও ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্ত থাকেন এবং প্রতারণার ঝুঁকিও কম থাকে। একজন হাজীকে কোরবানির জন্য প্রায় ৮০০ রিয়াল জমা দিতে হয়, যা পশুর দাম, কসাইখানার খরচ, মাংস সংরক্ষণ এবং দরিদ্র মুসলিমদের মধ্যে বিতরণের খরচ অন্তর্ভুক্ত।

আইডিবির এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রতিবছর বাংলাদেশেও কোরবানির দুম্বার মাংস দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণ করা হয়। কোরবানির মাংসের ব্যবহার কর্মসূচি বা স্যাক্রিফিশিয়াল মিট ইউটিলাইজেশন প্রোগ্রামটি পরিবেশগত সমস্যার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের খাদ্যের যোগান দিয়েছে।

প্রকল্প শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছে এবং সেসব মাংস মুসলিম দেশগুলোতে বিতরণ করা হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি মানুষের ঘরে পৌঁছেছে এই মাংস, যা আল্লাহর দান ও ইসলামের সত্যিকারের ভ্রাতৃত্বের এক অপূর্ব উদাহরণ।

ফরিদ 

×