
উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞানুসারে বর্জ্য হলো অবাঞ্ছিত বা অব্যবহারযোগ্য এমন যে কোনো পদার্থ, যা প্রাথমিক ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয় অথবা মূল্যহীন, ত্রুটিপূর্ণ পদার্থ। অন্যভাবে বলা যায়, বিভিন্ন উৎস থেকে আসা যেসব জৈব ও অজৈব পদার্থ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কাজে আসে না এবং স্বাভাবিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে সেগুলোকে বর্জ্য পদার্থ বা বর্জ্য বলে। যেমন- মাছের আঁশ, ফলমূল ও তরিতরকারির খোসা, পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যাগ, পরিত্যক্ত রাসায়নিক পদার্থ, পোড়া মবিল, ট্যানারির বর্জ্য, জাহাজ ভাঙা শিল্পের অ্যাসবেস্টস, পারদ, সিসা, ক্যাডমিয়াম, জাহাজের তলদেশ থেকে নিঃসৃত তেল ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ, হাসপাতালে ব্যবহৃত গজ, ব্যান্ডেজ, সিরিঞ্জ, তুলা, ওষুধের অবশিষ্টাংশ, সংক্রামক বর্জ্য, ফয়েল, মাইক্রোবায়োলজি বা বায়োটেকনোলজি বর্জ্য, হাটবাজারের বর্জ্য, কসাইখানার বর্জ্য, শিল্প-কারখানার বর্জ্য এবং সবচেয়ে ভয়ানক বর্জ্য হলো নিউক্লিয়ার চুল্লির বর্জ্য ইত্যাদি। বর্জ্য কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় যে ধরনেরই হোক না কেন, পরিবেশের ওপর তার বিরাট প্রভাব রয়েছে। মানুষ তার চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে বর্জ্য উৎপাদন করে থাকে। এসব কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় বর্জ্য পদার্থগুলো মাটি, পানি ও বায়ুতে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করে এবং সেইসঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের দেহের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। বর্জ্য নোংরা পরিবেশ সৃষ্টি করে, গলে-পচে দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং মশা-মাছি এ থেকে বংশবৃদ্ধি করে ও রোগ ছড়ায়। তবে বর্জ্য যেভাবেই উৎপন্ন হোক না কেন সেটা বিষয় নয়, মূল কথা হলো আমাদের উচিত পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাবকে রোধ করা বা প্রশমিত করা।
কঠিন বর্জ্য (Solid Wastes)- কঠিন বর্জ্য হলো সেসব বস্তু ব্যবহারের অনুপযোগী এবং পানিবাহিত হয়ে জলাশয়ে যায় না বা সরাসরি বায়ুমণ্ডলেও মেশে না। সব ধরনের মিউনিসিপ্যাল, গৃহস্থালি, কৃষিজ, শিল্প-কারখানার পরিত্যক্ত কঠিন পদার্থই এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। যেমন- ফলমূলের খোসা, পলিথিন, ভাঙা কাচ, ডাবের খোসা, প্লাস্টিক, বিষাক্ত ধাতু, হাসপাতালে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ব্যান্ডেজ, পরিত্যক্ত সিরিঞ্জ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ। এছাড়া খাদ্য-শৃঙ্খলে ভারি ধাতু যেমন- আর্সেনিক (As), ক্রোমিয়াম (Cr), লেড (Pb), ক্যাডমিয়াম (Cd) যুক্ত হলে তা প্রাণী ও উদ্ভিদ তথা পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। জাপানের জিন্টসু নদীর উপত্যকার জিংক আকরিকের খনি ও জিংক নিষ্কাশনের কারখানার বর্জ্য থেকে Cd(2+) আয়ন ওই নদীর পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে। ওই দূষিত পানি ধান উৎপাদনে সেচের কাজে ব্যবহার হওয়ার ফলে Cd দূষিত পানি থেকে চালে সঞ্চিত হয়। এ চাল খাওয়ার ফলে চাল থেকে ঈফ স্থানীয় মানুষের দেহে প্রবেশ করে। জিন্টসু নদীর উপত্যকায় বসবাসকারী মানুষের দীর্ঘদিন Cd দূষণের বিষক্রিয়ায় ১৯৬৮ সালে শতাধিক মানুষ বিশেষ রোগ ‘ইটাই-ইটাই’ বা আউচ-আউচ (Itai-Itai or Ouch-Ouch) রোগে আক্রান্ত হয়। এটি মূলত অস্থি সন্ধি ও অস্থি কাঠামোর রোগ। উল্লেখ্য, ক্যাডমিয়াম দূষণের ফলে কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তরল বর্জ্য (Liquid Wastes)Ñ তরল বর্জ্য হলো তরল তেজস্ক্রিয় পদার্থ, ক্ষতিকর তরল ময়লা, তরল রাসায়নিক পদার্থ ও ভারি পানি (D_2O) ইত্যাদি। তরল বর্জ্য দ্বারা মূলত মাটি ও পানি দূষিত হয়। তরল বর্জ্য পানিতে মিশলে পানির DO (দ্রবীভূত অক্সিজেন) কমে যায়। মাছ ও অন্যান্য প্রাণী যেগুলো DO গ্রহণ করে বেঁচে থাকে সেগুলোর জীবনধারণ ও বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এই দূষিত পানি পান ও ব্যবহারের ফলে মানুষের বিভিন্নরকম পানিবাহিত রোগ ও সংক্রামক ব্যাধি হতে পারে। এছাড়া দূষিত পানি উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।
গ্যাসীয় বর্জ্য (Gaseous Wastes)- মূলত CO, CO_2, NO, N_2O, SO_2, CH_4, CFC ইত্যাদি হলো গ্যাসীয় বর্জ্য। গ্যাসীয় বর্জ্য বায়ুমণ্ডলের আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। এর প্রভাবে এসিড বৃষ্টি হতে পারে। এরা তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। ফলে বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যেতে পারে। গ্রিনহাউস গ্যাস (CO_2, CH_4, CFC, O_3, N_2O) গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া ঘটায়। ODS (ওজোন ক্ষয়কারী উপাদান) ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বর্জ্য সমস্যার সমাধান- বর্জ্য সমস্যার সমাধান দুইভাবে করা সম্ভব
প্রাকৃতির উপায়- প্রাকৃতিক উপায়ে জৈব বর্জ্য সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু ধাতব পদার্থ, প্লাস্টিক বর্জ্যঘটিত সমস্যাকে প্রাকৃতির উপায়ে সমাধান করা সম্ভব নয়। বর্জ্যকে পচিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আশপাশের গাছপালা জৈব বর্জ্য থেকে CO_2 শোষণ করে নেবে। পচনের ফলে যে খনিজ লবণ উৎপন্ন হয় তা মাটিতে চলে যাবে।
প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে- এক্ষেত্রে একাধিক স্তরের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়ে থাকে। যেমনÑ
১। উৎস হতে পরিকল্পিতভাবে বর্জ্য সংগ্রহ।
২। বর্জ্য দাহ্য ও অদাহ্য হিসেবে পৃথক করা।
৩। পুনরাবর্তনযোগ্য বর্জ্যগুলোকে পৃথক করা।
৪। অদাহ্য পদার্থ যেমন- ধাতব পদার্থকে গলিয়ে পুনরায় ব্যবহার করা।
৫। দাহ্য বর্জ্যকে বিশেষ ধরনের চুল্লিতে পুড়িয়ে ফেলা। যাতে বিষাক্ত গ্যাস বের হতে না পারে।
৬। জৈব বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট সার, জৈব সার, বায়োগ্যাস প্রভৃতি তৈরি করা।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা- বর্তমান বিশ্বে বর্জ্য সমস্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনসংখ্যা ও শিল্প-কারখানা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যেমন উৎপাদন বাড়ছে, তেমনি বর্জ্যরে উৎপাদনও বাড়ছে। মানুষ তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করে উন্নত ও আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করতে আগ্রহী। এরূপ ঘটাতে গিয়ে মানুষ নিজের অজান্তেই অনেক বর্জ্য উৎপাদন করছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ বর্জ্য সমস্যা সমাধানে কি উপায় অবলম্বন করা যায় তা নিয়ে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। বর্জ্যকে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে অপসারণ করা ছাড়াও বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীতে রূপান্তর করার প্রচেষ্টাও চলছে। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রকৃতপক্ষে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে তা নিতান্তই কম। বর্জ্যগুলো যেখানে-সেখানে না ফেলে বর্জ্যরে জন্য একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকা একান্ত জরুরি। আশার কথা হলো, এসব বর্জ্য কোথায় কীভাবে ফেলা যায় এবং কীভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায় এসব নিয়ে নানাবিধ চিন্তা-ভাবনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। উইকিপিডিয়া অনুসারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে আবর্জনা সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পুনর্ব্যবহার ও নিষ্কাশনের সমন্বিত প্রক্রিয়াকে বোঝায়। উইকিপিডিয়ার অন্য সংজ্ঞানুসারে পরিবেশের অবনমন রোধ, মানব শরীর বিভিন্ন রোগের হাত থেকে মুক্তি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ইত্যাদির উদ্দেশ্যে বর্জ্যরে পরিমাণ হ্রাস, বর্জ্য সংগ্রহ, উপযুক্ত ব্যবস্থায় বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহার, নতুন সম্পদ সৃষ্টি, বর্জ্যরে যথাযথ ব্যবহার ইত্যাদির সম্মিলিত প্রক্রিয়াকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলে। অর্থাৎ বর্জ্যরে স্বাস্থ্যসম্মত অপসারণ এবং উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে রূপান্তর করে মানব কল্যাণে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা ও পরিকল্পনাকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলে।
বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কৌশল- বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
ক) গ্রামীণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা- গ্রামীণ বর্জ্য বলতে গৃহস্থালির বর্জ্য ও গৃহপালিত পশু হতে সৃষ্ট বর্জ্যকে বোঝায়। গর্ত করে কুয়ো পায়খানা তৈরি করে মলমূত্র ত্যাগ করলে পরিবেশ দূষিত হয় না। তরি-তরকারির খোসা, ফলের খোসা, আগাছা, খড়কুটা ইত্যাদি গর্তের মধ্যে পচিয়ে সার তৈরি করা যায়। গরু-মহিষের গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা থেকে বায়োগ্যাস ও সার তৈরি করা যায়। এভাবে গ্রামের পরিবেশ রাখা যায় বর্জ্যমুক্ত।
খ) শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা- শহরের বর্জ্য সমস্যা যেমন বড় সমস্যা, তেমনি সমাধানও বেশ জটিল।
গ) শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনা :
১। শিল্প-কারখানা হতে নির্গত গ্যাস শোধনের ব্যবস্থা করা।
২। শিল্প-কারখানা হতে নির্গত গ্যাস পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা।
৩। পোড়া তেল, পোড়া মবিল, রং, গ্রিজ ইত্যাদি পরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ ও শোধনের ব্যবস্থা করা।
৪। বর্জ্য পদার্থ পুনরাবর্তনযোগ্য হলে তার ব্যবস্থা করা এবং পুনরাবর্তনযোগ্য না হলে সেগুলো নির্দিষ্ট স্থানে জমা করা।
৫। বর্জ্য পানি পরিশোধন করতে ETP (Effluent Treatment Plant) ব্যবহার করা।
এছাড়াও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় 5R ধারণা (Reduce, Reuse, Recycle, Recover, Refuse), 4R ধারণা বা 3R ধারণা প্রয়োগ করা যেতে পারে। বর্জ্য সমস্যা সমাধানে সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। যেমন- কোনো কোনো উন্নত দেশে উৎপাদিত বর্জ্য উন্নয়নশীল দেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে অবৈধভাবে ফেলে দেয়। তাতে উন্নয়নশীল দেশের সমুদ্রের জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে। তাই সরকারের উচিত দেশের অভ্যন্তরে নজর দেওয়ার পাশাপাশি সমুদ্রসীমায়ও সমানভাবে নজর দেওয়া। পরিশেষে বলা যায়, আমাদের শুধু রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। পরিবেশ যদি দূষিত থাকে, স্বাস্থ্য যদি খারাপ থাকে তবে কী হবে এসব দিয়ে? তাই এখনই সময় পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুন্দর, নির্মল, বর্জ্য ও দূষণমুক্ত পৃথিবী উপহার দেওয়ার। না হলে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াত?
লেখক : গবেষক