
রাক্ষসী সাকার ফিস এবং পিরানহা মাছের দাপট
রাক্ষসী সাকার ফিস এবং পিরানহা মাছের দাপটে আমাদের দেশীয় প্রজাতি মাছ এখন বিপন্ন হতে বসেছে। এক সময় ঢাকার বুড়িঙ্গায় জেলেরা জাল ফেললে তাদের জালে দেশীয় প্রজাতির শিং, টেংরা, পুটি চিংড়িসহ নানা প্রজাতের মাছ মিলত জালে। কিন্তু বর্তমানে পুরো বুড়িগঙ্গা জুড়ে চলছে রাক্ষসী সাকার মাছের রাজত্ব। জেলেরা জাল ফেললে প্রতিটানে পাচ্ছেন ১৫ থেকে ২০ কেজি সাকার ফিস।
এত মাছ পেয়ে জেলেদের খুশি হওয়ার কথা থাকলেও তারা এখন খুশি হতে পারছেন না। তার কারণ, বিষাক্ত এ মাছ আমাদের দেশের মানুষ খেয়ে অভ্যস্ত নন। অন্যান্য দেশে এ মাছের বহুমুখী ব্যবহার থাকলেও আমাদের এখানে থাকছে খাওয়ার অনুপযুক্ত। এ মাছ দেশীয় প্রজাতি মাছের পোনা, ডিম এবং লার্ভা খেয়ে ধ্বংস করে ফেলে। তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারছে না দেশীয় প্রজাতি মাছ।
কিছু মাছ থাকলেও নদী বা জলাশয়ে অনুখাদ্যের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। তার কারণ রাক্ষসী এ সাকার জলজ উদ্ভিদ, আগাছা, পোকা-মাকড় সব খেয়ে চলছে নির্বিকারে। এ মাছ কি শুধু বুড়িগঙ্গায়ই সয়লাব হয়ে গেছে যে তা নয়। উত্তরাঞ্চলসহ ধলেশ্বরী, মেঘনা এবং পদ্মায়ও পাওয়া যাচ্ছে এ মাছ। বুড়িগঙ্গায় এখন ভয়ে কেউ গোসল পর্যন্ত করতে নামছে না। এ মাছ এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছে।
এ মাছ পানি ছাড়া শুকনা বালুময় অবস্থানে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারছে। অল্প অক্সিজেনে টিকতে পারে বলে যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে কোনো ধরনের সমস্যা হয় না এ সাকার মাছের। এ মাছের শরীরে রয়েছে প্রচুর পরিমানে গ্লুগোজ। তবে বুড়িগঙ্গা নদীর মাছে ক্ষতিকর রাসানিক থাকলেও অন্যান্য নদীতে এ মাছে ক্ষতিকর রাসায়নিকের অস্থিত্ব মেলেনি।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, এ মাছে রয়েছে ভারী ধাতু, কপার, লেড, ক্যামিয়াম, ক্রামিয়াম। সাকার মাছে আরও রয়েছে আমিষ ২৫ শতাংশ, চর্বি ৩.৭৫ শতাংশ, ক্যাসিয়াম এবং মিনারেল প্রচুর পরিমাণে। আর শুঁটকিতে আমিষের পরিমাণ ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। গবেষকরা ধারণা করছেন, ১৯৬২ সালে সানামতিনিও নদীতে এ মাছটির প্রথম দেখা মিলে।
তারপর এ মাছ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাজিল, পানামা, কোস্টারিকা এবং মেক্সিকো। মেক্সিকোর নদ-নদীর ৭০ শতাংশ দখল করে নিয়েছে এ ডেভিল ফিস বা শয়তান ফিস নামে পরিচিত এ মাছ। সেখানে প্রতিদিন টনে টনে জেলেদের জালে এ মাছ ধরা পড়ছে। কিন্তু কেউ না খাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় জেলেরা। এবার এ মাছের দাপট ঠেকাতে ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যবসায়ীরা মেক্সিকো জেলেদের সঙ্গে চুক্তি করে এ মাছ কুকুর-বিড়ালের খাদ্য তৈরি করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন।
সঠিক নিয়মে কেটে এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ করে যাচ্ছে মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সকোতে। তবে কুকুর বিড়ালের খাবার ছাড়াও মেক্সিকোর হোটেলগুলোতে ঢুকে পড়েছে সাকার ফিস। সেখানকার হোটেলগুলো মাছের নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে তৈরি করছে বার্গার, ফিস চিপস। সাকার মাছ দেখতে ভালো না হলে এর বার্গার এবং চিপস খেতে অনেক সুস্বাদু। এ মাছ খেলে অনেকটা তেলাপিয়া মাছের অনুভূতি পাওয়া যায়।
জলাশয়ের শত্রু খ্যাত এ মাছ ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে স্থানীয় অর্থনীতিতে। গবেষণা বলছে, এ মাছ একোরিয়াম, নদী এবং জলাশয়ে বেঁচে থাকতে পারে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্র্যস্ত। একই সঙ্গে এ মাছ ৫ শত ডিম পাড়ার ক্ষমতা রাখে। তবে অন্যান্য দেশে যখন মাছের বহুমুখী ব্যবহার করে নদ-নদীর বিপন্নতা ঠেকানো গেছে, এবার আমাদের এখানেও শুরু হয়েছে এ মাছের বহুমুখী ব্যবহার। একজন উদ্যোক্ততা নদী থেকে মাছ ধরে কুকুর বিড়ালের খাবার প্রস্তুত শুরু করে অনলাইনে বাজারজাত করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন।
আমাদের বুড়িগঙ্গা এখন দেশীয় জাতের মাছ প্রায় বিলীনের পথে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, কিছু কিছু মাছ ধলেশ্বরী, মেঘনা এবং পদ্মায়ও পাওয়া যাচ্ছে। এটি দ্রুত বংশ বিস্তারকারী মাছ। তাকে অতিসত্বর রোধ করা না গেলে আমাদের মাছ নিয়ে জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হবে। তাছাড়া একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ পিরানহা মাছ চাষ করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
তারা কৌশল হিসেবে শহরের অদূরবর্তী এলাকায় এ মাছের চালান পাঠিয়ে তা বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করেছেন। কেউ কেউ এ মাছ লাল রূপচাদা হিসেবে বিক্রি করছে। মুন্সীগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম এলাকায় এ মাছ বেশি পাওয়া যায়। মৎস্য অধিদপ্তর যদি এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে সাকার ফিসের মতো পিরানহা মাছও নদী দখল করে নেবে। আর এ রাক্ষসী মাছ একবার নদীতে পৌঁছতে পারলে ভয়ংকর এক পরিবেশ সৃষ্টি হবে নদীগুলোতে। তখন আর আমাদের কিছুই করার থাকবে না।
লেখক : সাংবাদিক