ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২

ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয়

সাকিবুল হাছান

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ৩১ মে ২০২৪

ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয়

.

ভূমিকম্প হচ্ছে ভূমির কম্পন। ভূ-অভ্যন্তরে যখন একটি শিলা অন্য একটি শিলার ওপরে উঠে আসে তখন ভূমিকম্পন হয়। পৃথিবীপৃষ্ঠের অংশবিশেষের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন বা আন্দোলনই ভূমিকম্পন। প্রকৃতির কাছে আমরা কতটা অসহায় তা বিভিন্ন প্রকৃতিক দুর্যোগের সময় বুঝতে পারি। দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো ভূমিকম্প। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং সুনামির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর লক্ষণ হিসেবে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও মৃদু মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত? বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে দশমিক মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। সুতরাং আমরাও ভূমিকম্পের রেড জোনে আছি। তখন আমাদের অবস্থা কতটা ভয়াবহ হবে চিন্তা করা উচিত। সময় থাকতেই সতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই। সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) জাইকার করা এক যৌথ জরিপে জানা যায়, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ। রিখটার স্কেলে মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্যাসলাইন নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে। কয়েক হাজার ভবন ধসে পড়বে। কারণ, আমাদের ভবনগুলো এখনো নিরাপদভাবে তৈরি হচ্ছে না। বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে লাখ সিলেটে লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়েও উঁচু। মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা যায়, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার কাজ করা কঠিন

হয়ে যাবে। এছাড়া ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা পরিবর্তন করে গড়ে ওঠায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। সময়ে  অপরিকল্পিত ভবনগুলো সঙ্গে সঙ্গেই ধসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দেশের বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরে অবকাঠামোগুলোর উন্নতির কথা বলছেন, পাশাপাশি সঠিকভাবে বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি নির্মাণের পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে শহর এলাকাগুলোতে বিশেষ করে ঢাকা শহরে যেভাবে পরিকল্পনাহীনভাবে বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে, তাতে মাঝারি কিংবা বড় কোনো ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে রাজউক-সিডিএসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সংশ্লিষ্ট সেবা খাতগুলো অর্থবহ নগর-জনপদ পরিকল্পনায় প্রায় ব্যর্থ বলেই জনশ্রুতি রয়েছে। অর্থের লোভে, বিবেক বিকশিত না করে শুধু ব্যক্তিস্বার্থে নদী-নালা-খাল-বিল-জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণের অনুমতি প্রদানে এক বিপর্যস্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামন্যতম ভবন নির্মাণ কোড-বিধিমালা না মেনেই শুধু কতিপয় কর্মকর্তার অর্থ লোভের কিংবা প্রভাবপ্রতিপত্তির কারণে দেশজুড়ে দুর্বল ভবন নির্মাণের প্রভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ নানামুখী আর্থ-সামাজিক কঠিন অসঙ্গতি অচিরেই দেশকে কোন্ পর্যায়ে পৌঁছে দেবে তা কল্পনাও করা যাচ্ছে না। তাই প্রথমে দেশের শহরগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ, নিয়মবহির্ভূতভাবে তৈরি করা ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে।

ভবন তৈরির সময় মাটির গুণাগুণ গুরুত্বের সঙ্গে পরীক্ষা করতে হবে। খাল, জলাশয় ভরাট করে ভবন তৈরি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে এবং প্রয়োজনে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন না করলে কয়েক লাখ মানুষের প্রাণ চলে যেতে পারে। তাই ভূমিকম্পের সময় এবং ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে করণীয় সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণা অবশ্যই রাখতে হবে। পাশাপাশি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য উদ্ধারকর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে প্রস্তুত রাখতে হবে। কারণ, উদ্ধারকারীদের দক্ষতার ওপর মৃত্যুর সংখ্যা কমবেশি হতে পারে।

ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে নিম্ন পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিম্নতম পর্যায়ে রাখার জন্য বাড়িঘর হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত। এই বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাকিব হাসান বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস করার মূল অস্ত্র হচ্ছে বিল্ডিং কোড মেনে চলা। কেবল বিল্ডিং কোড থাকলেই হবে না, প্রয়োজন এর সফল সঠিক প্রয়োগ। সেইসঙ্গে ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেওয়া। দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির কথা বলা হলেও উভয়ক্ষেত্রেই আমাদের অবস্থা এখনো খুবই শোচনীয়। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের প্রকৃত সময় এখনই। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা জরুরি।

লেখক : উন্নয়নকর্মী

 

×