ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

হোসেন তৌফিক ইমাম ॥ জীবনান্তিকা

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ১৭ মার্চ ২০২৪

হোসেন তৌফিক ইমাম ॥ জীবনান্তিকা

.

মার্চ ২০২১ বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম প্রয়াত হন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনে জনগণের সেবায় নিবেদিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর ভূমিকায় তিনি তার নাম প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

হোসেন তৌফিক ইমাম ১৯৩৯ সালের ১৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা ১৯৫৪ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী কলেজ থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক হন। এরপর ১৯৫৮ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে এম. ডিগ্রী অর্জন করেন। পরে তিনি রাজশাহী সরকারী কলেজে অর্থনীতির শিক্ষক হিসাবে কাজ করে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি) প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে যোগ দেন। চাকরিতে সময়কালীন তিনি ১৯৬৮ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের দুর্গ, লাহোরস্থ সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ২১ ফেব্রুয়ারির সকালে ভাষা শহীদদের স্মরণে কালোব্যাজ পরে খালি পায়ে তৌফিক ইমামের নেতৃত্বে সকল প্রশিক্ষণরত বাঙালি অফিসার তাদের ক্লাসে উপস্থিত হয়ে বাংলা ভাষা সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য তুলে ধরেছিলেন।

১৯৬২ সালে তৌফিক ইমাম তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসাবে রাজশাহী জেলা প্রশাসনে সহকারী কমিশনারের পদে তারুণ্যের প্রভা তৎপরতা নিয়ে সুনাম অর্জন করেন। এরপর তিনি নওগাঁ মহকুমার প্রশাসক হিসাবে যোগ দেন। আমি ১৯৬৬-৬৭ সালে তৎকালীন সিএসপির সদস্য হিসাবে নওগাঁর প্রশাসক বা এসডিও পদে কাজ করেছি। নওগাঁর যেখানে গিয়েছি, সেখানে তার দক্ষতা সততার কথা শুনেছি, জনগণের হিতার্থে তার বিভিন্ন কর্মকান্ডে পরিচিতি পেয়ে একই সার্ভিসের সদস্য হিসাবে গর্ববোধ করেছি। ১৯৭১-এর উত্তাল মার্চ মাসে তিনি রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক পদে যোগ দেন। তার সঙ্গে   সেই সময় যোগ দিয়েছিলেন সিভিল সার্ভিসে আমাদের অন্য এক স্বনামধন্য সহকর্মী সৈয়দ আব্দুস সামাদ।

১৯৭১-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়া স্বাধীনতার বার্তা তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি মহকুমা এখনকার বান্দরবান, খাগড়াছড়ি রাঙ্গামাটি জেলাতে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। সেই বছরের মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষিত বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- হৃদয়ে ধারণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সিএসপি সমিতির পুরোধা মুজিবুল হকের সভাপতিত্বে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীনতার সপক্ষে সকল তৎপরতা শুরু করার আহ্বান নির্দেশ নিয়ে আমরা কজন সুশীল সেবক বিভিন্ন জেলায় কর্মরত জেলা প্রশাসকদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য দায়িত্ব নেই। আমি তৎকালীন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক শামসুল হক (সিএসপি) নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল করিমের (সিএসপি) সঙ্গে দেখা আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহ্বান পৌঁছে দিয়ে ১৭ মার্চ চট্টগ্রামে উপস্থিত হই। সেখানে আরেক সিএসপি সহকর্মী জেলা প্রশাসক মুস্তাফিজুর রহমানের বাসস্থানে এবং পরদিন আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকির বাংলোতে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাপটেন মনসুর আলীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতা আন্দোলনে জেলা প্রশাসকদের তরফ হতে যথাসম্ভব সকল সহযোগিতা সমর্থন দেওয়ার আহ্বান তৌফিক ইমাম অন্যান্যের কাছে পৌঁছে দেই। তৌফিক ইমাম ফিরে গিয়ে সেদিন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সংগ্রাম স্থল হিসাবে পরিচালিত করতে থাকেন। মুষ্টিমেয় কতিপয় দেশদ্রোহী ব্যতীত সেই জেলায় কর্মরত সকল সুশীল সেবক অফিসার বিভিন্ন গোষ্ঠীর জনতার সঙ্গে মিশে স্বাধীনতার সংগ্রামে ব্রতী হন। অন্যান্যের মধ্যে জেলার পুলিশ তত্ত্বাবধায়ক বজলুর রহমান কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্বাহী শামসুদ্দিন জেলা প্রশাসক তৌফিক ইমামের নেতৃত্বে একাত্ম হয়ে যথা প্রয়োজন সংগঠন শক্তি প্রয়োগ করেন।

মে মাসে তিনি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী তাদের দালালদের বিরুদ্ধাচরণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সব্রুম হয়ে আগরতলায় তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হন। এখানে ভারতীয় সুশীল প্রশাসন সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে ফলপ্রসূ সংযোগ স্থাপন করে তিনি এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ব্যূহ গড়ে তুলেন। তার সঙ্গে দেশের পূর্বাঞ্চলে কর্মরত সহযোগীর ভূমিকায় থাকেন (পাকিস্তান) সিভিল সার্ভিসের কতিপয় উজ্জ্বল নক্ষত্র, সৈয়দ আব্দুস সামাদ, আকবর আলী খান, ওয়ালিউর রহমান, খসরুজ্জামান চৌধুরী, প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের শামসুদ্দিন আহমেদ ফয়েজ আহমেদ এবং পুলিশ সার্ভিসের বজলুর রহমান শাহ এম মজিদ। এই সময়ে আগরতলা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আগত অন্যান্যের মধ্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান আনিসুজ্জামানকে নিরাপদে স্বাধীন বাংলার সপক্ষে বাক বুদ্ধির যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সুযোগ সহায়তা প্রসারিত করেন তৌফিক ইমাম। তার সহায়তায় নিরাপদে সে এলাকায় আশ্রয় নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অনুকূলে প্রচার সমর্থনমূলক তৎপরতায় ব্রতী হন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মিজানুর রহমান চৌধুরী (চাঁদপুর), এম আর সিদ্দিকী (চট্টগ্রাম), খাজা আহমেদ (নোয়াখালী) এবং বিদ্রোহী সৈনিক মেজর রফিকুল ইসলাম (কুমিল্লা)

কবি আল মাহমুদ নির্মলেন্দু গুণ, শিল্পী কামরুল হাসান শাহাবুদ্দিন, কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জাব্বার, আপেল মাহমুদ সান্জিদা খান তাদের লেখা কণ্ঠ নিয়ে তৌফিক ইমামের সহযোগিতা সমর্থনে মুক্তিযুদ্ধকে সুদীপ্ত করার সুযোগ পান। তৌফিক ইমামের ব্যবস্থাপনা সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারকে এই প্রেক্ষিতে লক্ষ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আগরতলায় আগমন উৎসারিত প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সজ্জিত প্রয়োগ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর মার্চে প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী ১০ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিব নগরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সরকার প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। জুন মাসের দিকে  তৌফিক ইমামকে কোলকাতায় নিয়ে এসে প্রবাসী এই সরকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসাবে পদায়িত করেন। তিনি অদম্য প্রশাসনিক নিপুণতা আনুগত্যবোধ নিয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত সরকারের কাঠামো স্থাপন, ভারত সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা প্রসারণ এবং মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে সবল লোকবল যথাপ্রয়োজন অস্ত্র আহরণে নিরবচ্ছিন্ন সাহসিক ভূমিকা পালন করেন। ভারতীয় পক্ষে বাংলাদেশ বিষয়ক অন্যতম নীতিনির্ধারক ডি পি ধর পি এন হাকসারের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন তৌফিক ইমাম। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: এইচ.টি.ইমাম, বাংলাদেশ সরকার, ১৯৭১)

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বাদি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে সুবিন্যস্ত করে ১৮ তারিখ তৌফিক ইমামসহ কলকাতায় কর্মরত সাবেক সিএসপি অফিসার মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস, সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান এবং পুলিশের মহাপরিচালক এম খালেক ঢাকায় চলে আসেন। সেইদিনই মন্ত্রিসভার বিশেষ জরুরি বৈঠকে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের আশু অনুসরণীয় করণীয় বিষয়ে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

২৩ ডিসেম্বর ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে প্রধান প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দান, প্রাক্তন স্টেট ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক নামে নামকরণ, সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং বিদ্যমান সকল পাটকল রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, সনাতন গভর্নমেন্ট হাউসকেবঙ্গভবননামে শিলায়িতকরণ এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনকে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকারের দ্যোতকগণভবননামে নতুন পরিচিতি প্রদান। ৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকায় নতুন মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এই শপথ এবং এর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের শপথ বাক্য বাংলায় প্রণয়নে তৌফিক ইমামকে সহায়তা করেছিলাম আমি সহকর্মী আকবর আলী খান। জনাব ইমামসহ এইসব শপথ বাক্যের যে মোসাবিদা আমরা করেছিলাম তা এখনও বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি (দ্রষ্টব্য: পূর্বোক্ত বাংলাদেশ সরকার, ১৯৭১, পৃঃ২৭৭) তখন থেকে ১৯৭৫- বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের অযুত কর্মসমূহের আনুষ্ঠানিক গ্রহণ সম্পাদনে প্রস্তাবক, কেন্দ্রীয় রেকর্ড রক্ষক বাস্তবায়নে সারথির অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন তৌফিক ইমাম। এই সময়ে নব প্রতিষ্ঠিত সরকার সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়নীয় অনুসরণীয় যত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তত সিদ্ধান্ত ভিন্নতর দেশে কোনো সরকার এত অল্প সময়ে গ্রহণ করেছে বলে দেশের প্রশাসনিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।

ইতিহাসের নির্মম পরিহাস! স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব তৌফিক ইমাম বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর ১৯৭৫ সালের সেই প্রতিক্রিয়াশীল সেনা চক্রের নির্দেশে সেই বছরের ২৬ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশেই চাকরিচ্যুত কারারুদ্ধ হন। তাকে সেই অশুভ চক্র নানা রকম বাহানা দিয়ে ১৯৭৬-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত কারারুদ্ধ রাখে। উল্লেখ্য, ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে যে প্রকোষ্ঠে তাকে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল, সেখানে পরে ২০০৭ সালে সামরিক শক্তিতে আসীন তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাকেও মিথ্যা মামলায় অবরুদ্ধ রেখেছিল। ৭৫ সালের নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যার রাতে তৌফিক ইমাম কারাগারের সেই প্রকোষ্ঠে থেকেই দুঃসহ হত্যার নারকীয়তা অনুভব করেছিলেন। বছরের শেষ দিকে তার বিরুদ্ধে নির্লজ্জভাবে সামরিক আদালতে ২টি দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়।

দুটি মামলাতেই তৌফিক ইমাম নির্দোষ প্রমাণিত হন। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ অসদাচরণের অভিযোগ এনে প্রশাসনিক বিভাগীয় মামলা চালু করেন। ১৯৭৬ সালে সেই বিভাগীয় মামলায়ও তাকে সসম্মানে মুক্তি দেন তদন্ত কর্মকর্তা সৎ নিষ্ঠাবান বোরহানউদ্দীন আহমেদ (১৯৫০ সালের সিএসপি) তথাপিও তৎকালে নিযুক্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব পাকিস্তানপন্থি সফিউল আজম (১৯৪৯ সালের সিএসপি) তাকে কোনো পদে নিযুক্তি না দিয়ে অপমানিতভাবে বিশেষ কাজে নিযুক্ত কর্মকর্তা হিসাবে চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত রাখেন। পরে তাকে প্রশাসনিক স্টাফ কলেজের প্রকল্প পরিচালক হিসাবে সচিব থেকে নিম্নতর পদে পদায়িত করা হয়। তিনি পদত্যাগ না করে দেশের সরকারে থাকা তার অধিকার হিসাবে বিবেচনা করে অর্পিত দায়িত্ব প্রতিবাদহীনভাবে পালন করেন এবং পুনঃবিন্যাস উন্নয়নের ভিত্তিতে জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র  নির্মাণ করেন। তার নির্মিত জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক সদস্য হিসাবে ১৯৯১ সালে আমিও পদায়িত হয়েছিলাম। বিদ্যমান সরকারের অসহযোগিতার পরিধিতে এই কেন্দ্রের গঠন বিন্যাস আমাকে তৌফিক ইমামের কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচিতি তুলে ধরে মুগ্ধ করেছে। ১৯৮৪ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে এককালের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব তৌফিক ইমামকে সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে পদায়িত করা হয়। এই পদে থেকে তিনি নিপুণতার সঙ্গে যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প প্রণয়ন তার অর্থায়নের জন্য সুব্যবস্থা করেন। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ না হওয়ার আগেই তাকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে বদলি করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অন্যায় পদক্ষেপ দেশের সামরিক তার উত্তরসূরি সরকার নিয়েছিল, তা জাতির জন্য লজ্জাজনক।

দেশের সুশীল প্রশাসনের তরফ হতেও তৌফিক ইমামের প্রতি এই অবিচারের কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। এরপরে ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। অবসরে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০০৮ সালে অবাধ মুক্ত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি তাকে মন্ত্রীর পদমর্যাদাসহ জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন।

২০১৪তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রীর মর্যাদাসহ রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করেন। উপরন্তু এই সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য দলীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসাবে দক্ষতা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তেমনি নিপুণতা সংবেদনশীলতা নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের প্রচার প্রকাশনা কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। মনে আছে, এই সময়ে একবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি, তিনি নিজেই আমার অফিসে আসতে চেয়েছিলেন। আমি অবশ্য তার কথা অমান্য করে তার অফিসে যেয়েই তার সঙ্গে দেখা করেছি, প্রথাগতভাবে প্রবীণতর সহকর্মীর প্রতি যথাপ্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন করেছি। ২০২১-এর মার্চ তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি সুচারু সফলভাবে রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে নিষ্ঠা, সততা দেশপ্রেমের নজির রেখে যান। তিনি কাজের প্রখর চাপের মধ্যেও ৩টি বই লিখে গিয়েছেন : () বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, আগামী প্রকাশনী, () বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-’৭৫, হাক্কানী পাবলিশার্স, () স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিক ভাবনা, জার্নিম্যান বুকস। তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামী, নিষ্ঠাবান নিপুণ সহকর্মী হিসাবে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা জাতির জন্য লক্ষ্যানুগ হবে বলে আমি মনে করি।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী

 

×