.
আগের থেকে বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, মানুষ বর্তমানে অনেক রোগবালাই থেকে রক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ জনসাধারণ দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের মান এবং এর দূষণ সম্পর্কে খুবই অসচেতনএ যে কারণে হোটেল/রেস্তোরাঁর দূষিত খাবার খেয়ে বেশিরভাগ ভোক্তা পড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।
ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানের বেশিরভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁর বাইরের দৃশ্য চকচকে থাকলেও, খাবার তৈরির জায়গা দেখলে সচেতন মানুষ আঁতকে উঠবে। কথায় বলে না ‘বাইরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট।’ কোনো ভোক্তা যদি হোটেল, রেস্তোরাঁর রান্নাঘরের পরিবেশ দেখতেন তাহলে কেউ মুখে খাবার তুলতেন না। সাধারণত সামনের সাজসজ্জা করা অংশে খাবার খেয়ে বিল পরিশোধ করে বেরিয়ে পড়েন গ্রাহকরা।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত হোটেল-রেস্তোরাঁয় ম্যাজিস্ট্র্রেট কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বেশিরভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে স্যাঁতসেঁতে মেঝে, অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশ, মাছি ভন ভন করছে। তার মধ্যে চলছে কাটাকুটি এবং বাবুর্চি ও তাদের সহযোগীদের রান্নাবান্নার কাজ। অনেক সময় বাবুর্চি ও তাদের সহযোগীদের গা থেকে ঘাম ঝরে পড়তে দেখা গেছে খাবারের ওপর। পানি থেকে শুরু করে মসলা সবই নি¤œমানের। কোনো কোনো হোটেলের বিরুদ্ধে মরা মুরগি ও মরা ছাগলের মাংস পরিবেশনের অভিযোগও রয়েছে। মহিষের মাংস গরুর মাংস হিসেবে চালানো হচ্ছে। ফ্রিজে কাঁচা মাছ ও মাংসের সঙ্গে রান্না করা খাবার একই সঙ্গে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এমনও পাওয়া গেছে, ফ্রিজের মধ্যে রাখা কাঁচা মাংস থেকে ঝরে পড়া রক্তে পরাটার খামতি লাল রঙে রঞ্জিত হয়েছে। মবিল জাতীয় পোড়া পাম অয়েলে পরাটা, পুরি, লুচি, শিঙ্গাড়া, সমুচা, জিলাপি, বুনদিয়া, নিমকি, চপ ইত্যাদি ভাজা হচ্ছে। মাসাধিককাল পুরনো চিনির সিরায় জিলাপি, বুনদিয়া ইত্যাদি ভেজানো হচ্ছে। প্রস্তুতকৃত খাবার দেখতে বেশি আকর্ষণীয় করতে খাবারে নির্দ্বিধায় মেশানো হচ্ছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক কাপড়ের রং। বিশেষ করে রমজান মাসের নানা রকম ইফতারি তৈরি করার সময় এই রং মেশানোর প্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। এ ছাড়াও দোকানের বাইরে অসংখ্য খোলা স্থানে নর্দমার পাশে, ধুলাবালি, মশামাছি ভনভন করা পরিবেশে ওই সমস্ত খাবার প্রস্তুত করা হচ্ছে। পচা ও বাসি খাবার পরিবেশন এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। চাইনিজ রেস্তোরাঁগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও, এখানকার রান্নাঘরের অবস্থাও একই রকম অস্বাস্থ্যকর। এছাড়া এসব খাবারেও মেশানো হয়ে থাকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নানা রাসায়নিক। বিশেষ করে বেকারি পণ্য কেক ও বিস্কুটে পচা ডিম মেশানোর বিষয়টি সর্বজনবিদিত।
হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার পরিবেশনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ওয়েটার বা বয় বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের পোশাক-আশাক এবং খাবার পরিবেশনের ধরনে খাওয়ার রুচি থাকে না। সাধারণত দেখা যায়, তাদের কাঁধে থাকে একটা তোয়ালে বা গামছা। কাস্টমারের খাওয়ার পর তারা টেবিলে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করে এঁটো থালাবাসন ধোয়ার জন্য রান্নাঘরে পৌঁছে দেয়। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ওই সকল থালাবাসনগুলো দায়সারাভাবে ধুয়ে ওগুলো দিয়ে আবার নতুন কাস্টমারদের খাবার পরিবেশন করা হয়ে থাকে। ফলে, একদিকে দায়সারাভাবে ধোয়া থালা, বাটি গ্লাসে লেগে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, অন্যদিকে ওয়েটারের অপরিষ্কার হাতে পরিবেশন করা খাদ্যে খাবার দূষিত হয়ে ভোক্তার স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।
যে হাত দিয়ে টাকা গোনা হচ্ছে, সেই হাত দিয়েই বিভিন্ন প্রকার খাবার আইটেম যেমন– পরাটা, লুচি, পুরি, শিঙ্গাড়া, সমুচা, জিলাপি, চপ, কেক ও বিভিন্ন রকম মিষ্টান্ন সামগ্রী ক্রেতাদের সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দোকানিকে গ্লাভস, চামচ বা চিমটা ব্যবহারের কথা বললে তারা বিরক্ত বোধ করে। ফলে, টাকার গায়ে লেগে থাকা হাজার রকম ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস হাতের সংস্পর্শে এসে খাবার দূষিত হয়ে ভোক্তার স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়। পুরনো খবরের কাগজে ওই সমস্ত খাবার সরবরাহের সময় কাগজের ক্ষতিকর কালি খাবারের সঙ্গে লেগে খাবার দূষিত হয়েও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।
খাওয়ার আগে হাত, মুখ ধোয়ার জন্য বেসিনে সাবানের ব্যবস্থা থাকলেও, খাবার পর হাত মোছার তোয়ালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এতটাই নোংরা দেখা যায়, যা হাত-মুখ মোছার উপযুক্ত নয়। অনেক কাস্টমারকে দেখা যায়, খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার পরিবর্তে, খাওয়া শেষে হাত ধোয়ার জন্য হন্যে হয়ে সাবান খোঁজেন।
ঢাকা মহানগরী তথা বিভিন্ন শহর-গ্রামগঞ্জের জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ একদম বাধ্য হয়েই তিন বেলা হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার গ্রহণ করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে শ্রমিক, নি¤œআয়ের মানুষ, ব্যাচেলর, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গ্রাম থেকে শহরে কাজে আসা মানুষ, পর্যটক ইত্যাদি। চিকিৎসকদের মতে, হোটেল/রেস্তোরাঁর এ ধরনের মানহীন, দূষিত খাবার খেয়ে ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিস, টাইফয়েড, ক্রনিক লিভার, কিডনি ব্যাধি এমনকি ক্যান্সারের মতো মরণঘাতী রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে।
জনগণের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব সরকারের। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট খাদ্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের জোরালো তদারকির পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক এলাকাভিত্তিক পর্যায়ক্রমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে। প্রয়োজনে দেশে প্রচলিত ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’ লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর শাস্তির বিধান রেখে বিদ্যমান আইন সংশোধন করতে হবে। উল্লেখ্য, খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে চীনে মৃত্যুদ-, ভারতে যাবজ্জীবন ও যুক্তরাষ্ট্রে সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। তবে বিষয়টি শুধু সরকারের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। ভোক্তা হিসেবে আমাদেরও নিজ নিজ দায়িত্ব রয়েছে। কোথাও ব্যত্যয় দেখলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। অসাধু হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধি ও সরকারের গণমাধ্যমে প্রচার ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : সরকারি কর্মকর্তা (অব.)
huqmd.naymul @gmail.com
