ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনা

​​​​​​​ড. সমীর কুমার বিশ্বাস

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ৩ নভেম্বর ২০২৩

বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনা

.

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ঘোষণার ভিত্তিমূল হলো একটি ঐতিহাসিক প্রপঞ্চ যে কেবলমাত্র জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করার সক্ষমতা রাখে। সেই জনগণের জন্য এবং জনগণের সম্পৃক্ততায় বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনে নিয়ামক ভূমিকায় থাকবে জনগণ। যার ধারাবাহিকতায় রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেইগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশযেখানে সাংবিধানিকভাবেইপ্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ সাধারণ জনগণকে কেন্দ্রে রেখে রকম হৃদয়জাত সাংবিধানিক অঙ্গীকার পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। তাইতো বঙ্গবন্ধু সেই জনগণের জীবনমান নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করতে পারেনআমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলার মানুষ যেন পেট ভরে খেতে পায়, পরনে কাপড় পায়, উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।

বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা খুঁজে বের করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত চাইলেন। তাদের গভীর পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এলো অমিত সম্ভাবনাময় দেশের মাটি মানুষ, জল বৃক্ষ এবং পরিবেশ প্রকৃতিই সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর এই সম্পদকে যথার্থ অর্থে কাজে লাগাতে এবং  দেশের উন্নয়নের নিয়ামক করতে বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছিলেন সমবায় ভিত্তিক কর্মযজ্ঞ। কর্মযজ্ঞে তিনি ইতিহাসের চারণ হলেন- হলেন ঐতিহাসিক বরপুত্রদের আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের আবহমান বাঙালির যোগসূত্র কারিগর।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সংগ্রামী চেতনার আলোকে মনে করতেন যে, সমবায় একটি মানব কল্যাণমূলক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পদ্ধতি যার মাধ্যমে মানুষের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনারই স্বীকৃতি আমরা বর্তমান সময়ে এসেও পাই যখন দেখি ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গঠনে সমবায়ের অন্তর্নিহিত শক্তিমত্তার কথা জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে ২০১২ সালকে আন্তর্জাতিক সমবায় বর্ষ হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে। প্রেক্ষিতে তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব বান-কি-মুন তাঁর বাণীতে বলেছিলেন, ‘সমবায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দেয় যে অর্থনৈতিক মুনাফা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা একই সঙ্গে অর্জন সম্ভব।আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রী সংস্থা (আইসিএ) এর সভাপতির ভাষায়- ‘সমবায় মানুষের চাহিদা মেটানোর কাজ করে-লোভ মেটানোর কাজ করে না এসব কথা বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন বলে আমরা মনে করতেই পারি। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন সমবায় সমিতি একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠান নয়। সমবায় সমিতি এমন একটি  জনকল্যাণ উন্নয়নমূলক আর্র্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠান যার মধ্যে থাকে- গণতন্ত্র, অর্থনীতি, সম্মিলিত কর্মপ্র্রচেষ্টা, উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ, সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির প্রয়াস; সর্বোপরি সদস্যদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধন।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বা করতেন সমবায় একটি আন্দোলন চেতনার নাম, একটি আদর্শ এবং সংগ্রামের নাম। ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত হলেও সমবায় সমিতি কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নয়। সমিতিতে শেয়ার ক্রয় করে মুনাফা অর্জন করা সমবায়ীদের প্রধান লক্ষ্য নয়। সাতটি মৌলিক নীতিমালার ওপর নির্ভর করে সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, সেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ, উন্মুক্ত সদস্য হওয়ার সুযোগ, শিক্ষা প্রশিক্ষণ, তথ্য বিনিময় এবং সমাজকে সম্পৃক্ত করে উন্নয়ন হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। অধ্যাপক এম এম আকাশের মতে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমবায় মডেল হচ্ছে, ‘নমনীয় কিন্তু সুশৃঙ্খল, গণতান্ত্রিক কিন্তু বিতর্ক ক্লাব নয়। বাজারভিত্তিক কিন্তু পরিকল্পনা শূন্য নয়, ব্যক্তি উদ্যোগে বিশ্বাসী কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতায় নয়।

বঙ্গবন্ধু সমবায়কে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন দেশের প্রতিটি গ্রামে সমবায় সমিতি গঠন করা হবে। তিনি গণমুখী সমবায় আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সমবায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন যে কত গভীরে প্রোথিত ছিল এবং কত সুদূরপ্রসারিত চিন্তাসমৃদ্ধ তা লক্ষ্য করা যায় ১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সমবায় সম্মেলনে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্যের মধ্যে। সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেছিলেন- ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায়ের পথ-সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরিব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন-যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে। অন্যদিকে অধিকতর উৎপাদন বৃদ্ধি সম্পদের সুষম বণ্টন ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষুদ্র চাষি গণতান্ত্রিক অংশ অধিকার পাবে। জোতদার ধনী চাষির শোষণ থেকে তারা মুক্তি লাভ করবে সমবায়ের সংহত শক্তির দ্বারা। একইভাবে কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যদি একজোট হয়ে পুঁজি এবং অন্যান্য উপাদানের মাধ্যমে একত্র করতে পারেন তবে আর  মধ্যবর্তী ধনিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতি গোষ্ঠী তাদের শ্রমের ফসলকে লুট করে খেতে পারবে না। সমবায়ের মাধ্যমে গ্রাম-বাংলায় গড়ে উঠবে ক্ষুদ্রশিল্প যার মালিক হবে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক এবং ভূমিহীন নির্যাতিত দুঃখী মানুষ।

দেশজ উন্নয়ন ছিল বঙ্গবন্ধুর একান্ত ভাবনা। কুটিরশিল্প ক্ষুদ্রশিল্পকে তিনি সমবায় ভিত্তিতে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সাধারণ নির্বাচনের আগে ১৯৭০ সালের নভেম্বরে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বেতার টেলিভিশন ভাষণ থেকে আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধুর সমবায় চিন্তা। তিনি বলেছিলেনÑ ‘ক্ষুদ্রায়তন কুটির শিল্পকে ব্যাপকভাবে উৎসাহ দিতে হবে। কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁতিদের ন্যায্যমূল্যে সুতা রং সরবরাহ করতে হবে। তাদের জন্য অবশ্যই বাজারজাতকরণ ঋণদানের সুবিধা করে দিতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকৃতির শিল্প গড়ে তুলতে হবে। গ্রামে গ্রামে এসব শিল্পকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে যার ফলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিভিন্ন প্রকার শিল্প সুযোগ পৌঁছায় এবং গ্রামীণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সুষ্টি হয়।ছোট ছোট চাষিদের কথায়ও তিনি বিস্মৃত হননি। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয়করণের নীতি ঘোষণা উপলক্ষে বেতার-টেলিভিশনে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনÑ ‘ছোট ছোট চাষিদের অবশ্যই উৎপাদনক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। কথা মনে রেখে আমরা পল্লী এলাকায় সমবায় ব্যবস্থার ভিত্তিতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে চেষ্টা করছি। এর ফলে চাষিরা কেবলমাত্র আধুনিক ব্যবস্থার সুফলই পাবে না বরং সমবায়ের মাধ্যমে সহজশর্তে দ্রুত ঋণ পাওয়া সম্ভব হবে।

বঙ্গবন্ধু সমবায়কে দেখতেন নতুন সমাজ-আদর্শ সমাজ-দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে। তিনি দুর্নীতির কথা জানতেন-দুর্নীতিবাজদের কথা জানতেন-সমাজের পচনের কথা উপলব্ধি করতেন। এর থেকে মুক্তির জন্য তিনি সমবায় পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তাইতো ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণাকালে বলেছিলেনÑ ‘আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্ল্যাক মার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ।

যে হোর্ড করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। সমাজ ব্যবস্থায় যেন ঘুণ ধরে গেছে। এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই, যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের। সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণেধরা সমাজব্যবস্থাকে। আমি আপনাদের সমর্থন চাই। আমি জানি আপনাদের সমর্থন আছে কিন্তু একটা কথা, এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাব, তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে-গ্রামে এই কো-অপারেটিভ হবে। Ñআমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি ইনশাল্লাহ এদিন থাকবে না। -আমার যুবক ভাইরা, আমি যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে-গ্রামে এর উপর বাংলার মানুষের বাঁচামরা নির্ভর করবে।

রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলতেন,‘সমবায় নীতি মনুষত্বের মূলনীতি, মানুষ সহযোগিতার জোরেই মানুষ হয়েছে। সভ্যতা শব্দের অর্থই হচ্ছে মানুষের একত্রে সমাবেশ।বঙ্গবন্ধু হৃদয়ে গভীরভাবে রবীন্দ্রচেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন বলেই তাঁর সামগ্রিক দর্শনের ভিত্তিও ছিল মানুষের একত্রিত মহাশক্তির মহাসমাবেশ ঘটিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মকৌশল নির্ধারণ সেসবের কার্যকর বাস্তবায়ন। উন্নয়ন দর্শনে তাই নিঃশঙ্কচিত্তে তিনি প্রাধান্য দিয়েছিলেন সমবায়কে। আর সেটি আজ তাঁরই সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার অভিব্যক্তি কর্মকুশলতায় জনমনে সীমাহীন প্রভাব ফেলছে। তবে এক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সকলের মানসিকতার পরিবর্তন, ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ, উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রয়োগ। বঙ্গবন্ধুর সমবায় দর্শনের এসব ভিত্তিকাঠামোকে আমাদের হৃদয়েও ধারণ করতে হবে। আর আমরা যদি তা করতে পারি এবং যথার্থ অর্থেই ইতিবাচক মানসিকতায় ঋদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বহুবিধ সমবায়বান্ধব কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সংকল্পবদ্ধ হই তবেই কেবল বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত সোনার বাংলার সফল রূপায়ণ সম্ভব।

 লেখক : যুগ্মসচিব (পিআরএল), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সমবায় অধিদপ্তরের সাবেক যুগ্মনিবন্ধক

 

×