ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ॥ উন্নত বাংলাদেশের রূপরেখা-২

প্রকাশিত: ২১:০২, ৬ মে ২০২২

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ॥ উন্নত বাংলাদেশের রূপরেখা-২

টেকসই উন্নয়ন, অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ও উর্ধগতি সূচকের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে এখন একটি মর্যাদাপূর্ণ দেশ এবং উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। করোনাকালীন সময়েও ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। বর্তমান সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ধরে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে, যার সুফল জনগণ পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। করোনা মহামারীর কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই বিনিয়োগ খাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা গেছে বিশ্বের সকল দেশগুলোতে। মহামারীর দরুণ বৈদেশিক বিনিয়োগের হার হ্রাস পেয়েছে এবং এফডিআই প্রবাহও হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশের এফডিআই বৃদ্ধির গতি খানিকটা ব্যাহত হলেও দেশে বেসরকারী খাতের বিনিয়োগের পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় ইতিবাচক। ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উল্লেখযোগ্য দিক হলো এ পরিকল্পনায় শক্তিশালী ভূমি প্রশাসন গড়ার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। গভীর পরীক্ষণের মাধ্যমে অধিকতর স্পষ্ট ও সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করে যেসব প্রতিষ্ঠানকে ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভূমি প্রশাসন। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এনইসি সভাকক্ষে একনেক চেয়ারপার্সন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (জুলাই ২০২০ - জুন ২০২৫) চূড়ান্ত মুদ্রিত সংস্করণটির মোড়ক উন্মোচন করেন। পরিকল্পনা কমিশন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকে। দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশ এখন তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে ৪১১ বিলিয়ন ডলারের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। ফলে বিপুলসংখ্যক পণ্য ও সেবার জন্য বাংলাদেশ এক বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে। এফডিআইয়ের (সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ) জন্য সঠিক সময় বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশে আসা বিদেশী বিনিয়োগকারী, সহযোগী সংস্থা, কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, তুলনামূলক কম মজুরি, বিপুল কর্মক্ষম যুবশক্তি, স্থিতিশীল মুদ্রা বিনিময় হারের কারণে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিনিয়োগের আকর্ষণ। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, দেশকে তুলে ধরতেই এবারের বিনিয়োগ সম্মেলন। সফল এ সম্মেলনেও এসেছে কাক্সিক্ষত পরিমাণের বিদেশী বিনিয়োগ। ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট ভূমি বাজার ব্যবস্থা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শক্তিশালী করা এবং এজন্য ব্যাপকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক, নিয়ন্ত্রণমূলক ও রাজস্ব নীতি সংস্কার সাধন করার কথাও বলা হয়েছে। এই সংস্কারগুলোতে ভূমি রেকর্ডসমূহ কম্পিউটারে সংরক্ষণ, ভূমি হস্তান্তর ও নিবন্ধন সহজীকরণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ভূমি হস্তান্তর ও ভূমি নিবন্ধন ফি নির্ধারণের ভিত্তি হবে জমি/স্থাবর সম্পত্তির বাজারমূল্য। এতে করে সরকারের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-বহির্ভূত রাজস্ব উল্লেখযোগ্য বেড়ে যাবে বলে আশা করা হয়েছে পরিকল্পনাটিতে। এ ধরনের সংস্কারের ফলে লুটেরা ভূমিদস্যুদের থাবা থেকে দরিদ্র কৃষকদের রক্ষা করা যাবে। ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া থেকে অপ্রত্যাশিত মুনাফা আদায়ের পথে একটি প্রবল অন্তরায় তৈরি করবে বলে বলা হয়েছে পরিকল্পনায়। অপ্রত্যাশিত পুঁজি আদায় কমাতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হবে ভূমি হস্তান্তরের ওপর উপযুক্ত মূলধন প্রাপ্তির ওপর করারোপ। এর ফলে একদিকে যেমন ভূমির ফটকাবাজারি নিরুৎসাহিত হবে এবং ভূমির মূল্য স্থিতিশীল থাকবে, তেমনি সামাজিক সেবায় ব্যয়ের জন্য তা সরকারের ভা-ারে জোগান দেবে গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব আয়। ভূমি প্রশাসন উন্নয়নের কৌশল হিসেবে ভূমি ব্যবস্থাপনার ডিজিটাইজেশনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভূমির বিভিন্ন রেকর্ড এমনভাবে ডিজিটালাইজেশন করা হবে যাতে এসব মাঠ পর্যায়ের ভূমি সম্পর্কিত তিনটি দফতর তথা জেলা প্রশাসক (কালেক্টর অফিস), উপজেলা ভূমি অফিস (এসি ল্যান্ড অফিস) ও ভূমি নিবন্ধন দফতরের (বিশেষত সাব-রেজিস্ট্রার অফিস) সহজে আয়ত্তাধীন থাকে। এমন হলে প্রয়োজন অনুযায়ী ডাটার সহজলভ্যতা ও দ্রুত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি নিশ্চিত হবে। ডিজিটালি রক্ষণাবেক্ষণকৃত জমির প্লট-ভিত্তিক ক্যাডাস্ট্রাল (ভূমি সম্পদ সম্পর্কিত) জরিপ থেকে প্রাপ্ত স্পষ্ট ও নির্ভুল খতিয়ানসমূহ, ভূমি হস্তান্তরের নিবন্ধিত দলিলাদি ও জমির নামজারির বিবরণীসমূহ, জমির পূর্ববর্তী লেনদেন, বর্তমান মালিকানা অথবা উত্তরাধিকারের কার্যকর এবং স্বচ্ছ প্রমাণীকরণের ভিত্তি হবে। এছাড়াও অধিকতর উত্তম জনসেবা প্রদানের জন্য একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস বিতরণ ব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজন আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে পরিকল্পনায়। বিগত পাঁচ অর্থবছরের ভূমি সেক্টরে উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে ই-মিউটেশন (ই-নামজারি) ও ই-রেজিস্ট্রেশনের (ই-নিবন্ধন) কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ই-নামজারি (মিউটেশন) কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করে পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা বাদে দেশব্যাপী জুলাই ২০১৯ সাল থেকে শুরু হওয়া ই-মিউটেশন কার্যক্রম ভূমি খাতের পুনর্গঠনের একটি বড় পদক্ষেপ। এটি ভূমি প্রশাসনে অধিকতর জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। পরিকল্পনায় আরও উল্লেখ আছে, সরকারী খাস জমি ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা প্রয়োজন। ভূমি রেকর্ড ও জরিপের অটোমেশন হলে এ সম্পর্কিত লেনদেনের ব্যয় ও অসঙ্গতিগুলো আরও কমে আসবে। উল্লেখ্য, ভূমি মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কিত ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্প’ ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প নামে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পরিকল্পনায় আশা প্রকাশ করা হয়, আশ্রয়ণের মতো গৃহায়ন প্রকল্পের আওতায় দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের বসতির জন্য খাস জমি বরাদ্দের ব্যাপারে ভূমি মন্ত্রণালয় অগ্রাধিকার প্রদান করবে। চা বাগানের শ্রমিকদের আবাসনের জন্য বাগান মালিকদের নিজস্ব এস্টেটের কিছু জায়গা বরাদ্দ করতে উৎসাহিত করা হবে। সুইপার কলোনি নির্মাণের মতো বিশেষ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ। ২০২৫ সালে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়ে ৪১তম অবস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ১৯৩টি দেশের মধ্যে, যা বিগত বছর ছিল ৪৩তম। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ৮২৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২০ সালে ছিল ৭২০ বিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনীতির দিক থেকে অন্যান্য দেশে চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক এ্যান্ড বিজনেস রিসোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৬তম, ২০২৮ সালের মধ্যে ২৭তম এবং ২০৩৩ সালের মধ্যে ২৪তম অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে বাংলাদেশ। ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩০তম। করোনার কারণে ২০২১ অর্থবছরের বড় একটা সময় ব্যাংকিং কার্যক্রম ছিল সীমিত। তারপরও আগের বছরের তুলনায় এ খাত থেকে সরকারের আয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০, ভূমি ব্যবহার, ভূমি জোনিং, আবাসন, উপকূলীয় অঞ্চলে নতুন ভূমি পুনরুদ্ধার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে করণীয় ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে পরিকল্পনায়। একটি সমীক্ষার বরাত দিয়ে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়, গ্রামীণ এলাকায় বিপুলসংখ্যক বিবাদ জমির সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও এর মধ্যে অনেক গ্রাম আদালতে সমাধান করা যায় না। কারণ, গ্রাম আদালতের সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের ক্ষমতা ৭৫ হাজার টাকা, যার চেয়ে জমির মূল্য সাধারণত অনেক বেশি হয়ে থাকে। ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের সফল দেশ পরিচালনার আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দেশ পরিচালনার ভার যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য হাতে আছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ২০২৫ সালের মধ্যে গৃহীত সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে দেশ উন্নয়নের পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক নীতিগুলো একটি পাঁচ বছরমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রণয়ন করে, যা সম্মিলিতভাবে ‘পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত । পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মূল ভিত্তি। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে বিভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারিত হয় । বিনিয়োগের ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে তার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে ২০২০-এর ২৯ ডিসেম্বর। ২০৪১ সালে দেশের দীর্ঘমেয়াদী ২০২২-৪১ সালের প্রক্ষেপিত উন্নয়ন কাঠামোয় এটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ১ জুলাই ২০২০ থেকে। পরিকল্পনাটি সমৃদ্ধির প্রচার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির এজেন্ডা নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিশেষে, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অন্য সকল পরিকল্পনার আপেক্ষিকতায় সবচেয়ে বেশি বিন্যাসিত, জনকল্যাণমূলক ও বাস্তবধর্মী জাতীয় কর্মপ্রচেষ্টার সমাহার ও প্রতিফলন। এর সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের সারিতে পৌঁছাতে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে অবশ্যই। লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
×