ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

হায়দার মোহাম্মদ জিতু

ডিজিটাল প্লাটফর্মে মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২ ডিসেম্বর ২০২০

ডিজিটাল প্লাটফর্মে মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ

অনলাইনে কেনাবেচার বিস্তৃত বাজার এ্যামাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোসকে তার স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদে ৩৫ মিলিয়ন ডলার বা ৩ লাখ কোটি টাকা খোয়াতে হয়েছে। জীবদ্দশায় তিনি হয়ত এই টাকার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বাঙালী জাতির যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনই পূরণীয় নয়। যার ফলে আজও বাঙালীকে ক্ষেত্রবিশেষে ভুগতে হচ্ছে। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক বাস্তবতাকে বিসর্জন দেয়া হয়েছিল। যে বঞ্চনা মুক্তির শপথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতৃত্ব সাহসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছে। পাকিস্তান পরবর্তী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আবারও বঞ্চনার ভূমিতল বা দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। এক কথায় নেতৃত্ব জবরদখলের লালসার ক্যান্সারে আক্রান্ত ‘তথাকথিত নেতাদের’ আবির্ভাব ঘটেছে। ক্রমাগত রক্তপাতের সংঘাত এবং জাতীয় মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপেক্ষা করে বিভাজিত হয়েছে বাংলার মানসিক মানচিত্র। ফলাফল মৌলবাদ, ক্যু এবং মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদে ক্রমাগত বাংলার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। তবে বাঙালীর সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুর পর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলার হাল ধরেছেন। বেহুলার ভাসান যাত্রার মতো একক কারিশমায় এগিয়ে নিচ্ছেন দেশকে। যদিও তাঁর এই পথ সহজ ছিল না। এই নেতৃত্ব অর্জন এবং এগিয়ে নেবার নেপথ্যে তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। গ্রেনেড, গুলি, বোমা ও প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্রের মৃত্যুবাণকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। যা তাঁকে করেছে আরও পরিণত এবং প্রজ্ঞাবান। ১৯৮১ এর ১৭ মে শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরেছিলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৪। কোলে ৯ ও ১০ বছরের দুই শিশু সন্তান। যা তৎকালীন আটপৌঢ় সমাজ ব্যবস্থায় ‘ঘর কন্যা’ থেকে যাবার নিয়ামক। কারণ তখনও বাঙালী মেয়েরা আজকের মতো স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা সেই ট্যাবু ভাঙ্গার নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঘর আগলে দল ও দেশকে সামলেছেন। তবে এই পথচলায় শেখ হাসিনাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, জামায়াত-শিবিরের। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শ বিরোধী সম্মিলিত চক্রকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। কারণ বাংলার বুকে তখনও বিক্রি হওয়া বুদ্ধিজীবী এবং ধর্মের নামে আফিম বেচা লোকজনের চূড়ান্ত দাপট ছিল। সেই সমস্ত পথ পাড়ি দিয়েই বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়কর রাষ্ট্র। তবে অতীতের সেই মৌলবাদী এবং পাকিস্তানী প্রেমীরা আজও বাংলাদেশ বিরোধী কাজে সক্রিয়। তবে এখন সেটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং কিছু উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে মোকাবেলা সম্ভব। নিরীক্ষণ দৃষ্টিতে বললে তাদের মূল হাতিয়ার হলো মুক্তিযুদ্ধের মিথ্যাচার, জাতির পিতার সম্পর্কে বিভ্রান্তি এবং রাষ্ট্রকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত। এক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে তাদের মতো মিথ্যাচারমূলক আচরণ না করে এককভাবে শুধু দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরতে পারলেই তাদের অবস্থান পরিষ্কার পেয়ে যাবে। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের গৃহীত উন্নয়ন বাস্তবতা ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রযুক্তির বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের ডিজিটাল আর্কাইভ নির্মাণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার পথ-ঘাট, গ্রাম, পাড়া, মহল্লা সবটাই পাকিস্তানীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এমনও হয়েছে গ্রাম আক্রান্ত হওয়ায় একটি পরিবার গাছ-গাছালি যুক্ত বাগানে লুকিয়েছেন। কিন্তু সঙ্গে থাকা মাত্র ভূমিষ্ঠ শিশুর কান্নায় ধরা পড়ে গেছেন এবং শেষমেশ মারা পড়তে হয়েছে পাকিস্তানীদের বুলেটের আঘাতে। সন্তান এবং পরিবারের সামনে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে মা-বোনকে। এমন হাজারো টুকরো টুকরো নির্মম সত্য ছড়িয়ে আছে বাংলার প্রতি গ্রাম-উপত্যকায়। ভিন্নভাবে বললে, বাংলার প্রত্যেক গ্রামগুলো থেকে ১০ মিনিট করেও মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো তুলে আনলে তা দাঁড়াবে প্রায় কয়েক লাখ মিনিট। পাকিস্তানী ভাবাদর্শ বাস্তবায়নে যারা ইতিহাস বিকৃতির মতো নোংরা খেলা খেলেছিলেন এবং এখনও খেলবার চেষ্টা করছেন তাদের মোকাবেলা করতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সর্বস্তরে তুলে ধরাই যথেষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের গ্রাম-গ্রামান্তরের টুকরো বাস্তবতাগুলোকে ডিজিটাল প্লাটফর্মে যুক্ত করতে পারলেই ইতিহাস বিকৃতিকারীদের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রযুক্তির ব্যবহারে বিনির্মাণ করা সম্ভব মানবিক সংস্কৃতির মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সাহসিকতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এ লড়াই, সংগ্রাম এবং সংযমের বাস্তবতাকে সিনেমার পর্দায় আনা জরুরী। ২০১৭ সালের এক হিসেবে দেখা গেছে ণড়ঁঃঁনব এ প্রতি মিনিটে প্রায় ৪০০ ঘণ্টা আপলোড করা হয়েছে। কাজেই বৈশ্বিক জনপ্রিয় এই মাধ্যমের উপযোগী করে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতাকে ছোট ছোট কনটেন্ট করে সিরিজ আকারেও প্রকাশ করা যেতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলোতে বৈশ্বিক দূতাবাস এবং জাতিসংঘের বারান্দায় মুক্তিযুদ্ধে এদেশের গণহত্যার নথি এবং তথ্য উপস্থাপন করা যেতে পারে। সঙ্গে গুগল ম্যাপে গণহত্যার স্থানগুলোকে চিহ্নিত করে বধ্যভূমির সাইন যুক্ত করা যেতে পারে। ৯০ দিনে অন্তত একবার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাই গ্রাহক হিসেবে গণ্য। সে হিসেবে এদেশের ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। কাজেই এই বিপুল সংখ্যক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর জন্য মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ শিরোনামে একটি এ্যাপ নির্মাণ জরুরী। যা বৈশ্বিক ব্যবহার উপযোগী হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের এক ব্যাটল অফ শিরোমণিই বহির্বিশ্বের সমরকৌশলে পাঠ্য। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের সকল বাস্তবতাকেই সামনে আনা জরুরী। লেখক : ছাত্রনেতা [email protected]
×