ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ নাসিম

জাতীয় চার নেতার ত্যাগের ঋণ শোধ করার সময়

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ৩ নভেম্বর ২০১৯

 জাতীয় চার নেতার ত্যাগের ঋণ শোধ করার সময়

মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে জওহরলাল নেহরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মতিলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাস, চক্রবর্তী রাজাগোপালচারী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলসহ অনেকে শামিল হয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশের হাত থেকে স্বাধীন ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চীনের কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে ঝৌ এন লাই, লি দাজাও, চেন দুজিউ, চেন গংবো, তাং পিংশানসহ সহযোগীরা বিপ্লবের মাধ্যমে চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার জাতির জনক সুকর্নের পুরো নাম কুসনো সুসরোদিহাদর্জু। তার নেতৃত্বে মোহাম্মদ হাতা, সুতান সাজারির, আমির জারিফুদ্দিন, আব্দুল হালিম, মুহাম্মদ নাতসির, মোহাম্মদ হামাসহ সহযোগীরা নেদারল্যান্ডন্সের কাছ থেকে ইন্দোনেশিয়াকে স্বাধীন করেছিলেন। একইভাবে বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে একাত্তরে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মলাভ করে। এই স্বাধীনতার সংগ্রামে জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন- জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে সেখানকার কারাগারে বন্দী করে রাখে। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সব দিক নির্দেশনা বঙ্গবন্ধু দিয়ে গিয়েছিলেন। তার নির্দেশনা মেনেই মুজিবনগর সরকার গঠন করেছিলেন জাতীয় চার নেতা। দুঃসাহসিক ও গৌরবময় সেই মুহূর্তগুলো প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ সেই দিনগুলোতে আমার পিতা এম মনসুর আলী কী দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনতে এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কাজ করে গেছেন, তা আমি দেখেছি। খন্দকার মোশতাকের মতো কয়েকজন সুযোগ সন্ধানী মুজিবনগর সরকারের এই চার নেতার মধ্যে ফাটল ধরাবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। বেইমান মোশতাক স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোস করার নানা প্রলোভনের জাল বিস্তার করে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বকে বারবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু একটি বিপদগ্রস্ত এবং জাতির যুগসন্ধিক্ষণে শহীদ এম মনসুর আলী অন্য তিন নেতার সঙ্গে থেকে সব ভয়ভীতি, অনিশ্চয়তা এবং প্রলোভন উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করেছেন। সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আমার বাবা সেই ক’মাস মুজিবনগরের রণাঙ্গনে ছুটে বেরিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রবাসী সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে হাজার হাজার দলীয় সহকর্মী এবং দেশ থেকে পালিয়ে আসা মানুষকে আর্থিক সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। আমি প্রত্যক্ষ করেছি- হাজারো অমানিশার মধ্যেও সাধারণ বাঙালীর চেয়ে দীর্ঘদেহী আমার পিতার উজ্জ্বল প্রত্যয়দীপ্ত মুখচ্ছবি। সহকর্মীদের উদ্দেশ্য তিনি সর্বদা বলতেন- ‘বাঙালীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা ইনশাআল্লাহ্ মুক্ত করব।’ জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে মুজিবনগরে যে মুক্তিযুদ্ধর সফল নেতৃত্ব সংগঠিত হয়েছিল, তা নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে। জাতির সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনার দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ওই দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি। আর আমার বাবা এম মনসুর আলী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারী বাসভবনে আমরা সপরিবারে বসবাস করতাম। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার দুঃসংবাদটি যখন আমার বাবা পেয়েছিলেন, তখন তিনি কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। আমার মা, ভাই-বোন সবাই ভেঙ্গে পড়েছিলাম। বাকরুদ্ধ অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হতেই দেখলাম- তিনি শিশুর মতো অঝোরে কাঁদছেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান কেএম শফিউল্লাহসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের টেলিফোনে প্রতিরোধের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কাপুরুষের দল কেউ এগিয়ে আসেনি। অসহায় মনসুর আলী সহকর্মীদের পরামর্শে আত্মগোপনে চলে গেলেন। কিন্তু আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ও দেখেছি-কী উ™ে^গ, প্রচন্ড বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর কথা মনে করছেন। অন্যদিকে প্রতিশোধ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে দলীয় সহকর্মী, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু সহকর্মীর ভীরুতা, আপোসকামিতা এবং জীবনরক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা, অন্যদিকে সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের কাপুরুষতার কারণে মনসুর আলী ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের পরপরই আমার বাবা মনসুর আলীকে খন্দকার মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এম মনসুর আলী বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। জীবন দেব, তবুও তোমার মতো বেইমানের সঙ্গে হাত মেলাব না।’ ৩ নবেম্বর কারা অভ্যন্তরে অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে জীবন দেয়ার মধ্য দিয়ে তিনি তার কথা রেখেছেন। নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করেননি। সেদিন কারা অভ্যন্তরে যেভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে, এমন পৈশাচিক হত্যাকান্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ সেই পৈশাচিক ঘটনা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। বিশ্বাসঘাতক জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। তাদের মন্ত্রী বানিয়ে গাড়িতে লাল-সবুজের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। এমনকি জাতির পিতা ও তার সহযোগী চার জাতীয় নেতার নামও ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টাও করেছিল। পরবর্তী সামরিক শাসক এরশাদও জিয়ার পথে হেঁটছেন। খালেদা জিয়াও তাদের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর জনগণের সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেন। এরপর ২০০১ সালে ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসীন হয়। আবারও পাকিস্তানী ভাবধারায় রাষ্ট্র পরিচালনা হতে থাকে। এরপর ২০০৮ সাল থেকে আল্লাহ্র অশেষ রহমতে জনগণের রায়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছেন। এই সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনা জাতির পিতার হত্যাকারী, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করেছেন। দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। তবে একটি কথা না বললেই নয়। ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী চার জাতীয় নেতার স্মৃতি ধরে রাখতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। জাতীয় চার নেতার নামে শুধু রাজধানী ঢাকায় কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। গত মেয়াদে আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিন জাতীয় নেতার নামে তিনটি মেডিক্যাল কলেজের নামকরণ করেছি। এর বাইরে আর কিছুই হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় চার নেতার নামে কিছু করা যায় কি-না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। তাদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানালে হয়তো জাতির ঋণের বোঝা কিছুটা কমবে। পরিশেষে বলব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ দুর্বার গতিতে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলছে। শত বাধা বিপত্তি, ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই শেখ হাসিনা দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি দেশব্যাপী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছেন। অনেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। অনেকে গ্রেফতার আতঙ্কে আছেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাও আছেন। ক্ষমতায় থাকতে নিজ দলের ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির ইতিহাসে ™ি^তীয়টি আর নেই। সত্যিকারের দেশপ্রেম ও দেশের প্রতি ভালবাসা না থাকলে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। চলমান এই অভিযানের মধ্য দিয়েই দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা হবে। দলের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে আমার শহীদ পিতা এম মনসুর আলীর আদর্শ বুকে ধারণ করেই বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমার বোন, আমার নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমৃত্যু কাজ করে যাব। লেখক : এমপি, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
×