ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুই বাংলার বইমেলা

প্রকাশিত: ০৩:২৬, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

দুই বাংলার বইমেলা

কলকাতা পুস্তকমেলায় যাওয়া হয়েছে কয়েকবার। পাবলিশার্স গিল্ড আয়োজিত মেলা। বিশাল পরিসর। আমাদের বাংলা একাডেমির মতো ঠেলাঠেলি ভিড় নেই। বেশ নড়েচড়ে মেলায় ঘোরা যায়। প্রচুর বই, প্রচুর স্টল। আনন্দ পাবলিশার্সের সামনে লম্বা লাইন। একজন একজন করে ভেতরে ঢুকছে। একজনের কেনা বা দেখা হলে আরেকজন। অত সময় নেই তাই সামনে পা বাড়াই। ভাল বই আছে অনেক, প্রকাশনার মানও ভাল। প্রকাশনায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার গত শতকের নব্বই দশক থেকে এ শিল্পকে আমূল বদলে দিয়েছে। আমাদের দেশে প্রকাশনার পেছনের কাজ কমিয়ে দিয়েছে। খুব অল্প সময়ই বাজারজাত করা যাচ্ছে উৎপাদিত বই। এতে প্রচুর বই বাজারে আসছে। ভেতরে বিষয় যাই থাক প্রকাশনার মান নিঃসন্দেহে বেড়েছে। প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। অনেক শিক্ষিত তরুণ আগ্রহী হচ্ছেন এ পেশায়। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর বাংলা প্রকাশনার জগতে যে শূন্যতা এসেছিল ভাষা আন্দোলন তাতে গতি এনেছে। ভাষা আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল কিছু তরুণ সৃজনশীল সাহিত্যিক। তাঁদের লেখা প্রকাশে প্রকাশনা শিল্প যেমন প্রাণ পায় তেমনি পাঠকও পেয়েছিলেন সমৃদ্ধ সাহিত্য। স্বাধীনতার পর নানা সঙ্কট পেরিয়ে প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে চললেও এ সময় থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার একধাপে তাকে যেন এগিয়ে দিয়েছে অনেক বছর। এ সময় থেকে বিশ্বে অর্থনীতিসহ নানা ধরনের পরিবর্তন ও প্রকাশনা শিল্পের প্রেক্ষাপটকে নানা মাত্রায় উন্মোচিত করেছে। টেলিভিশনের ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটায় চেনা পরিবেশ কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠছিল। তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে এরপর বার বার প্রশ্ন উঠেছে বই কি হারিয়ে যাবে? ভেঙ্গে পড়বে কি প্রকাশনা শিল্পের ভিত? সব আশঙ্কা পাশ কাটিয়ে প্রকাশনা শিল্প টিকে আছে। যতদিন মানুষ থাকবে বইও থাকবে ততদিন। বই কখনও হারাবে না। তথ্যপ্রযুক্তি প্রকাশনার শত্রু নয়। বরং এর সহায়তা নিয়ে বইয়ের মান দিন দিন আরও উন্নত হবে। আজকের একটি সাধারণ প্রকাশনার প্রকাশিত বই আর বিশ-পঁচিশ বছর আগে প্রকাশিত বইয়ের তুলনা করলে পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে যায়। মানুষের কেনার ক্ষমতাও বেড়েছে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। তারপরও অনেক সময়ই শোনা যায় বই বিক্রি আশানুরূপ হচ্ছে না। তরুণরা বই পড়ছে না। তরুণরা হয়ত তথ্যপ্রযুক্তির দিকে বেশি ঝুঁকেছে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পড়ছে না বলে তাঁদের অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে এটাও দেখা উচিত তারা কি পড়বে? তাদের পড়ার উপযোগী বই কি বাজারে প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে? ফুলপাখি লতাপাতা গোছের বই দিয়ে তো তাদের খুশি করা যাবে না। সংখ্যার দিক থেকে প্রচুর বই বাজারে আসছে কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে গুণগতমানের জায়গাটা তেমন প্রসারিত হয়নি। বইয়ের প্রচ্ছদ, ছাপা, বাঁধাই দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় কিন্তু মলাট খুলে বেশি দূর এগোনো যায় না। পড়ার উপাদান থাকছে খুব কম বইয়ে। তাত্ত্বিক আলোচনা বা ভাবগম্ভীর বিষয়বস্তুই যে ভালো বই এর পূর্বশর্ত তা। নয় আকৃষ্ট করার কিছু না কিছু আধুনিক উপকরণ না থাকলে পাঠক কেন বই কিনবেন। বিপণনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় ছিল যখন পাঠক ছিল বইয়ের প্রতি একনিষ্ঠ। সেই পাঠকের চারপাশে বই ছাড়াও এখন আগ্রহের অনেক এলাকা তৈরি হয়েছে। মনোযোগ বাড়াতে তার সামনে বই তুলে ধরার কৌশলেও পরিবর্তন আনতে হবে। পাঠক ব্যস্ত। তার মন বিক্ষিপ্ত। কিন্তু যিনি প্রকাশনা খুলেছেন ব্যবসার জন্য তাকে তো পুরোপুরি পেশাদারী মনোভাব নিয়েই এগোতে হবে। ‘পড়ছে না’ ‘কিনছে না’ এ সব অভিযোগের মায়াকান্নায় ক্রেতার মন গলবে না। যে মোড়কে যেভাবে উপস্থাপন করলে পাঠক আগ্রহী হয়ে তাকাবেন সেভাবেই তার কাছে পৌঁছাতে হবে। ভারতের দে’জ পাবলিশিং হাউসের কর্ণধার অপু দে এক সাক্ষাতকারে বিষয়টি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা উল্লেখ না করে পারছি না “অডিও ভিস্যুয়ালের যুগে মানুষ সব কিছু ড্রয়িংরুমে বসে পেতে চান। সাবান, তেলসহ বিভিন্ন কনজিউমার ডিউরেবল যেভাবে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে, বইকেও একই পথে হাঁটতে হবে, কারণ সেটাও একটা পণ্য। ... প্রকাশনা আর পাঁচটা ব্যবসা থেকে আলাদা, তাদের নৈতিক দায়িত্ব অনেক বেশি এই তত্ত্বকথা শুনতে ভালো, কিন্তু অস্তিত্বের প্রশ্নে মেনে চলা কঠিন। আজকের মুক্তবাজারে লড়াইয়ে টিকে থাকতে গেলে গোঁড়ামি ভেঙ্গে পণ্যকে উপভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে হবে এটাই সাফ কথা। যাঁরা প্রকাশনা জগতের মূল কারিগর অর্থাৎ লেখকদের এই সময়কে ভাল করে উপলব্ধি করতে হবে।” কথাগুলো শুনতে কর্কশ মনে হলেও বাস্তবতা কিন্তু এটাই। একে মেনে চলার সময় হয়ত সত্যিই এসেছে। আমাদের বই মেলায় ঘুরলে যে জরুরী বিষয়টি স্পষ্ট হয় তা হলো মান নিয়ন্ত্রণ। বই এর বিষয়বস্তুর মান নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। পুস্তকমেলা থেকে বিকেলে ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুরবাড়ির নারীরা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন শিক্ষা-দীক্ষা আধুনিকতার জন্য। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকে মূলত এ পরিবারে নারী শিক্ষার প্রসার। তাঁর মেয়ে স্বর্ণকুমারী দেবী বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক লেখিকা হিসেবে পরিচিত। এ বাড়ির সবচেয়ে আধুনিকমনা শিক্ষিত নারী ছিলেন সম্ভবত জ্ঞানদা নন্দিনী দেবী। স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগিতায়ই তা সম্ভব হয়েছিল। বাল্য বিবাহের বিধান মেনে ঠাকুরবাড়িতেও নয়-দশ বছরের মেয়েরা বউ হয়ে স্বামীর ঘর করতে আসতেন। বিয়ের পর সত্যেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ‘তুমি যে পর্যন্ত বয়স্ক, শিক্ষিত ও সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে, সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে প্রবেশ করিব না।’ প্রথা ভেঙ্গে এ বাড়ির মেয়ে-বউদের পড়ালেখা শেখাতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরুষ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন অন্তঃপুরে। তারা চলনে বলনে সে সময়ে সমাজে অগ্রণী হয়ে উঠেছিলেন। পারিবারিক পত্রিকায় লিখতেন, নাটকে অভিনয় করতেন। তারপরও ইতিহাসের তথ্য জানায় সে সময়ের নারীর জীবনে সমাজ বাস্তবতার অভিঘাত নিয়ে প্রথম আত্মজীবনী যিনি লিখেছিলেন তিনি ঠাকুরবাড়ির কেউ নন। মফস্বলের এক সাধারণ নারী রাস সুন্দরী দেবী। শুধু নারী নয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাংলা সাহিত্যে প্রথম আত্মজীবনীকার তিনি।
×