ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নক্ষত্রের চির বিদায় ॥ শোকে বিহ্বল চট্টগ্রামবাসী --শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

নক্ষত্রের চির বিদায় ॥ শোকে বিহ্বল চট্টগ্রামবাসী  --শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশ। মৃতদেহ নগরের লালদীঘি ময়দানে আনা হলে সেখানে লাখো মানুষ জড়ো হন এই নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। লালদীঘি ময়দানে শুক্রবার বিকেলে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নামে। চট্টগ্রামের গণমানুষের এ নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে লালদীঘি ময়দানে হাজির হয়েছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। ওই ময়দানসহ আশপাশের সড়কে ছিল মানুষ আর মানুষ। ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্ম নেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পিতার নাম হোসেন আহমদ চৌধুরী আর মাতা বেদুরা বেগম। আট ভাইবোনের মাঝে তিনি ছিলেন মেঝ। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই সান্নিধ্যে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে আইএসআইয়ের চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমি সদর দফতরের কাছে গ্রেফতার হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন দীর্ঘ চার মাস। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও সেই নির্যাতনের চিহ্ন বহন করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একদিন মানসিক রোগীর অভিনয় করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে সম্মুখসমরে অংশ নেন। তিনি ছিলেন ভারত-বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে। জাতির জনকের খুব কাছের আর আদরের ছাত্রনেতা ছিলেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন সময়ে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়েও ক্ষমতার মোহ একচুলও স্পর্শ করেনি তাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জাতির জীবনে নেমে আসে ঘোর দুঃসময়। আকস্মিক ট্র্যাজেডিতে বিপর্যস্ত হয় বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এই বিপর্যস্ত সময়ের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে এর মধ্যেই একদিন ছদ্মবেশে তিনি যান টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে। সমাধি বলতে তেমন কিছু ছিল না। বাঁশের সীমানাও ভালভাবে ছিল না। গোপালগঞ্জ তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ছিল। তিনি চট্টগ্রাম থেকে নির্মাণ শ্রমিক নিয়ে যান। ফরিদপুর থেকে ইট আর সিমেন্ট সংগ্রহ করে বঙ্গবন্ধুর কবর ঘিরে পাকা দেয়াল তুলে দেয়া হয়েছিল। দক্ষিণ কাট্টলী থেকে শ্বেতপাথরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ লিখে নিয়ে সেটা কবরে লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের প্রধানতম নেতা হিসেবে গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে ভূমিকা পালন করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ে দ্স্থু মানবতার পাশে দাঁড়িয়ে, স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তার নিরলস কাজ করার কথা অবিস্মরণীয়। পরবর্তীতে ‘বন্দরটিলা ট্র্যাজেডি’তে গান পাউডারে ক্ষতবিক্ষত মানুষের লাশ নিজের হাতে ধুয়ে ও দাফন করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি। কালুরঘাটে গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু বা বন্দরটিলায় নৌবাহিনীর সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের দাফন-কাফন, সৎকারে সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে গরিব-দুঃখী-শ্রমিকের অধিকারের কথা বলে মহীরুহে পরিণত হন তিনি। কালক্রমে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নমণি হয়ে উঠেছিলেন এ নেতা। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সাধারণ এক শিশু নিজ গুণ ও যোগ্যতায় একদিন পরিণত হলেন চট্টগ্রামের ভাগ্য বিধাতা হিসেবে। নগ্ন পাহাড় ঘেরা ঝোপঝাড়ের একটি জঞ্জালের শহরকে পরিচ্ছন্ন করে রূপ দেন আধুনিক শহরে। ১৯৯৪ থেকে শুরু করে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে টানা ১৭ বছর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সিটি মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। চট্টগ্রাম নগরীকে আধুনিক শহরে রূপান্তর করতে যে মানুষটি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাকে আধুনিক চট্টগ্রামের রূপকার মনে করেন নগরবাসী। তার রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল একটাই- চট্টগ্রামের উন্নয়ন, চট্টগ্রামের মানুষের উন্নয়ন। জীবনের প্রয়োজনে বারবার কষ্টকে জয় করেছিলেন তিনি। আর জীবিকার প্রয়োজনে হয়েছিলেন চা দোকানের কর্মচারী, বাসের হেলপার, রেডিও মেকানিক, পত্রিকার হকার। আর এভাবেই সকল বাধাকে পদদলিত করে সাধারণ মহিউদ্দিন চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ একজন মানুষ। রাজনৈতিক জীবনে ষাটোর্ধ বয়সেও তিনি কারাগারে ছিলেন দীর্ঘ দুই বছর। এর মধ্যেই তিনি তার আদরের মেয়েকেও হারান। নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। সেই অনন্য এবং অদম্য সাহসী জননেতা, চট্টলবীর হিসেবে খ্যাত মহিউদ্দিন চৌধুরী তার ভক্ত, অনুগতসহ সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। চট্টগ্রামের উজ্জ্বল নক্ষত্র মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে দলীয় নেতাকর্মীসহ হাজার হাজার মানুষ গভীর রাতেই হাসপাতাল ও তার বাসভবনে ভিড় জমায়। ভক্তদের মাঝে দফায় দফায় কান্নার রোল ওঠে। রাজনীতির পরিসীমা ছাড়িয়ে মানবিকতার বিরল দৃষ্টান্ত গড়েছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। নির্যাতিত, বঞ্চিত গণমানুষের নেতা হিসেবে চট্টগ্রামের মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি সব সময় আপনজনের মতো পাশে ছিলেন। তার মৃত্যুতে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। লেখক : শিক্ষাবিদ আগ্রাবাদ সরকারী কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
×