ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় নায়করাজ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৪ আগস্ট ২০১৭

বিদায় নায়করাজ

রুপালি পর্দায় নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন অনেকেই। তবে সবাই নায়করাজ হন না। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কিংবা মুম্বাইয়ের অলকাপুরীতে বিভিন্ন সময়ে অনেকেই নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ও করছেন। তবে তাদের কেউ নায়করাজ হননি অথবা বলা যায় হতে পারেননি। চলচ্চিত্রের লাখো-কোটি দর্শক সবাইকে নায়করাজ বানান না; বরং নায়কদের মধ্য থেকে সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল, গৌরবোজ্জ্বল, সুদর্শন, সর্বাধিক জনপ্রিয়, অভিনয়গুণে গুণান্বিত সর্বোপরি যথার্থ নায়কোচিত একজনকেই তারা নায়করাজ অভিধায় ভূষিত করেন। মুম্বাইয়ের বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র জগতে যেমন কিংবদন্তিতুল্য নায়ক দিলীপ কুমার, পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র জগতে যেমন মহানায়ক উত্তম কুমার, পাকিস্তানের যেমন মোহাম্মদ আলী, বাংলাদেশে তেমনি অবিসংবাদিত নায়করাজ রাজ্জাক। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট। ৭৫ বছরের দীর্ঘ জীবনে ৫৩ বছর তিনি প্রায় এককভাবে শাসন করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতকে। এই জগতের অগুনতি অভিনেতা-অভিনেত্রী, প্রযোজক, পরিচালকগোষ্ঠী, নির্মাণশিল্পী, কলাকুশলী সর্বোপরি জনতার দরবারের দৃষ্টিতে একবাক্যে তিনিই ছিলেন যথার্থই নায়করাজ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের স্বীকৃত সম্রাট। কিংবদন্তির এই অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক আর আমাদের মধ্যে নেই। গত সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তাঁর এই মৃত্যুতে চলচ্চিত্রাঙ্গন শোকাচ্ছন্ন ও মর্মাহত। দুর্ভাগ্যতাড়িত আবদুর রাজ্জাক ১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসেন একজন শরণার্থী হিসেবে। কলকাতায় অভিনয় করতেন মঞ্চ নাটকে; দু-একটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তবে সেখানে সুবিধা করতে না পেরে ভাগ্যান্বেষণে চলে আসেন ঢাকায়। একেবারে চলচ্চিত্রের গল্পের মতোই শুরু হয় এই দুর্গম পথচলা। ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্পের শুরুও প্রায় তখন থেকেই। প্রথম অভিনয় করেন উজালা ছবিতে। এরপর ১৯৬৬ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের লোককাহিনী নির্ভর ছবি বেহুলায় লখিন্দর চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। ব্যস, ছবি সুপারহিট। মনে রাখতে হবে যে, তখন ঢাকার সিনেমা হলগুলোতেও পাক-ভারতীয় ছবির প্রবল দাপট। সে সব নায়কের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একের পর এক হিট ছবি উপহার দিয়ে চলেছেন রাজ্জাক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত অধিকাংশ সুপারহিট ছবির প্রায় একচ্ছত্র নায়ক রাজ্জাক। তবে তাঁর এই দুর্দমনীয় ও অপ্রতিহত অভিযাত্রা অব্যাহত ছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। শেষদিকে বাংলাদেশে ও পশ্চিমবাংলার যে সব চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেছেন সেখানেও তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য, অতুলনীয়, নায়কোচিত। আর তাই নায়করাজের চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। মহানায়কের মৃত্যু বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে ঈর্ষণীয় বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। আর কোন অভিনেতা তাঁর তুল্য অভিনয় প্রতিভা, দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। লোককাহিনী নির্ভর ছবি থেকে শুরু করে জীবনঘনিষ্ঠ সামাজিক ছবি সর্বোপরি মাস্তান তথা খল চরিত্রেও অভিনয় করে তিনি দুর্দান্ত অভিনয়শৈলীর স্বাক্ষর রেখেছেন, যা এককথায় অনবদ্য, অতুলনীয় ও ঈর্ষণীয়। আবার প্রেম-ভালবাসার রোমান্টিক চরিত্রেও তিনি ছিলেন সুদর্শন, সাবলীল ও সপ্রতিভ। দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান ঘোর দুর্দিনেও তিনি রেখেছেন অভিভাবকের ভূমিকা। তবে আফসোস রেখেছেন এই বলে, আন্তরিক চেষ্টা ও সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শেষটা গুছিয়ে রেখে যেতে পারেননি। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ অগণিত জ্ঞানী-গুণীজন ও বিপুলসংখ্যক দর্শককুলের অন্তিম ভালবাসায় অভিষিক্ত হয়ে শেষ বিদায় নিয়েছেন রাজ্জাক। এখন বাকিদের কাজ হবে, চলচ্চিত্র শিল্পের গৌরব পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে নায়করাজের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো।
×