ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৪ অক্টোবর ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

ভাদ্রের বৃষ্টি অর্থাৎ ভাদর বাদর নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও আবেগমথিত হয়েছেন; লিখেছেন- ঝরে ঝরঝর ভাদরবাদর বিরহ কাতর শর্বরী...। ঢাকার নাগরিকদের ভাদ্র-বৃষ্টি দেখার সুযোগ মেলে বটে, যদিও আশ্বিনের শেষার্ধে আর তেমন বৃষ্টি হয় না সচরাচর। এবার বোধহয় ব্যতিক্রম। রীতিমতো শ্রাবণকে পরাস্ত করে দেয়ার মতো বাদলধারা। না বর্ষাকাব্য লিখতে বসিনি, উল্লেখ করছি কেবল রাজধানীর পরিবর্তনশীল জলবায়ুর কথা। ধুলো ধোঁয়া ইট কাঠ কংক্রিটের নগরে শরতের সময় তার সৌন্দর্য থেকে হিমহিম সান্নিধ্য থেকে অনেকটা বঞ্চিত থাকতে হয়। একদিকে হঠাৎ বৃষ্টি, অন্যদিকে নিদারুণ গরম- এ নিয়েই সপ্তাহ কেটেছে ঢাকাবাসীর। তবু এরই মাঝে ঢাকের বাড়ি পড়ছে পুরনো ঢাকায়। সৃজিত হচ্ছে প্রতিমা- এসবের খানিকটা তুলে আনছেন টিভি প্রতিবেদক। ফলে শহরের অন্যসব প্রান্তের মানুষও জানতে পারছেন শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হলো বলে। আজকের লেখায় নগরবাসী শরৎ-সন্ধানের টুকরো ছবি তুলে ধরার চেষ্টা নেব। সেইসঙ্গে গণপরিবহনের অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার বয়ান থাকবে। আরেকটি প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে উঠে আসবে- সেটি হলো এই নিষ্ঠুর নগর থেকে কবির বিদায়কালে মানুষের হৃদয় উৎসারিত ভালবাসার কথা। সত্য প্রকাশের দায়বোধ জেনে আমাদের উচ্চারণ করতেই হবে এই ভালবাসার সমান্তরালে কিছু নিষ্ঠুর অর্বাচীনের ধৃষ্টতার কথাও। কাশবনে বাদামী ঘোড়া কাশবনে ছুটন্ত ট্রেনের ছবি আমাদের চোখে লেগে আছে সত্যজিৎ রায়ের কল্যাণে; সেখানে অপু দুর্গার যুগল বিস্ময় আমাদের হৃদয়ে চির জাগরূক। কাশবন কন্যাদের ফটোসেশন আমরা দেখতে পাচ্ছি অধুনা ফেসবুকের সৌজন্যে। কিন্তু কাশবনে ধাবমান বাদামী ঘোড়া! রাজধানীর ট্রেডমার্ক কাশবন হলো দুটি: দিয়াবাড়ি ও বসুন্ধরার ৩০০ ফুট রাস্তার পাশের প্রান্তর। লালমাটিয়া থেকে উত্তরা আসার পথে বাদামী ঘোড়া দেখে গাড়ি থামিয়েছিলেন এক নিকট আত্মীয়া- ছবি দেখুন। দেখে মনেই হবে না এটি ঢাকার একটি অংশ- যেন যুক্তরাজ্যের দৃশ্য। ঘোড়া নিয়ে কবি শামসুর রাহমানের অবসেশন কম ছিল না। তার কত কবিতাই না উঠে এসেছে বিচিত্র মাত্রিকতায়। ডানাওয়ালা ঘোড়ার পদশব্দ গুনেছি কত! দিয়াবাড়ির ঘোড়াটি দেখলে নিশ্চয়ই কবির কলম নিশ্চল থাকত না। বসুন্ধরার ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে দলেবলে ঢাকাবাসী চলেছেন শারদীয় মাধুর্য উপভোগে। এসব দৃশ্যের কথা আমি শুনেছি শুধু নারীরাই ছিলেন, গৃহিণী কর্মজীবী মুক্তনারী। এদের সবারই কৈশোরে যে কাশফুল স্বপ্ন জাগিয়েছে, এমন নয়। তবে কাশফুলের এই অবারিত নন্দিত তাদের আকর্ষণ করেছে। আহ্বান জানিয়েছে নির্মল আনন্দ অবগাহনে। আমাদের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়, বহমান যে আনন্দধারার মধ্যে আমরা প্রশ্বাস গ্রহণ করি তার ঐশ্বর্য ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি না। যখন তার প্রভাব ঘটে তখনই কেবল হাসফাঁস করে উঠি। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে এই যে আমরা ছ-ছটি ঋতুর পৃথক সৌন্দর্য আস্বাদন এবং তার মহিমা উপভোগের সৌভাগ্য পৈত্রিক সূত্রের মতো। দৈশিক সূত্রে পেয়ে গেছি- তার মূল্য কি যথাযথভাবে অনুভব করে থাকি? আমার এ কথায় অনেকেই হয়ত হা হা করে উঠে বলবেন, গরম ছাড়া আর কোন ঋতুই তো গায়ে এসে লাগে না। হ্যাঁ, গ্রীষ্মের প্রচ- প্রভাব বিদ্যমান এই গাঙ্গেয় অববাহিকায়, তাই বলে শীতেও কিছু কম যায় না; তার কনকনে থাবা নিয়ে উপস্থিত হয় আমাদের দরজায়। তা সে যত স্বল্পকালীনই হোক না কেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হওয়া সত্ত্বেও আমরা পৃথিবীর সেই গুটিকতক ভাগ্যবান দেশের অন্যতম যার নাগরকিরা শরৎ ও হেমন্তের মতো আশ্চর্য দুটি মৌসুমের বিচিত্র দুর্লভ রসে সিক্ত হয়ে থাকে। বর্ষার কথাইবা কোন্ অকৃতজ্ঞ করে অস্বীকার? বরষা আহা বাংলার বরষা! তাতে মন ভিজিয়ে উদাসী বাঙালী একেবারে লবেজান। যেমন ছিন্নভিন্ন অপার ফাল্গুনে, প্রতিটি নব বসন্তে। যাক, শিবের গীত রেখে শরতের সাথী হওয়া যাক। বলেছি দেশের ভেতরে থেকে দেশকে অনেক সময় ঠিকঠাক মূল্য দিই না। এই ক্ষুদ্র জীবনে একবারই কেবল একটি শরতে আমি দেশ থেকে দূরে ছিলাম। শীতার্ত সেই দূর দেশে একেবারে প্রথমবারের বিরহীর মতো মর্মে অনুভব করি বাংলার শরৎকে। আশ্বিনে আসীন নিঃশব্দ ও সশব্দ রাজ্যপাটকে। মানে তার অভাববোধকে। রীতিমতো হাহাকার করেছে মন শরতের সঙ্গে প্রেম করতে না পেরে। শরৎরসে ভাবনাগুচ্ছকে চড়িয়ে শুভ্রবসনা রজনীগন্ধার মতো একরাশ তন্বী মেঘের সঙ্গী হওয়ার সামান্যতম সুযোগও মেলেনি সেই শীতজর্জর বিলেতে। তখনকার আনপ্রেডিক্টেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা হু হু করে উঠত। কোথায় রোদে ধোয়া নীলাভ নীলিমা। কোথায় মৃদু-মন্দ ঠা-া ঠা-া বাতাসের ছোঁয়া। সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের মাঘই এসে গায়ের ওপর হামলে পড়েছিল সেই সেপ্টেম্বরের লন্ডনে। ঢাকায় পরের বছরের শরৎকে তাই একটুও কাছছাড়া করিনি। যাকে বলে সুদে-আসলে উসুল করে নেয়া। শরৎ নিয়ে আপনার পাশের জনকেই কিছু বলতে বলুন। অবধারিতভাবে তিনি বলবেন, কাশবন আর শেফালির কথা, পরিষ্কার আকাশে ছোট ছোট ভেলার মতো সাদা মেঘেদের ভেসে বেড়ানোর কথা, আর শিশির দূর্বার কথা। হাসফাঁস গরম থেকে বাঁচার কথাটিও উচ্চারণ করতে ভুলবেন না। এসবই সত্য, শরতের ট্রেডমার্ক। কিন্তু একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন, আপনার জীবনে, আরও স্পষ্ট করে বলি আপনার মন ও মননে শরৎ কোন আশ্চর্য জানালা খুলে দেয়। সেই জানালা দিয়ে মনের চোখে তাকালে আপনি হয়তো পেয়ে যান এক নতুন ভুবন। নতুন বীজধানের মতো নতুন দিনের স্বপ্নকে। ভেবে দেখুন, আমি অসত্য বলেছি কিনা? হ্যাঁ, এখানেই শরতের স্বাতন্ত্র্য। মহানগরী ঢাকায় গ্রামীণ শরতের আমেজ ও আবেশ চান? যেতে পারেন উত্তরার দিয়াবাড়ি। বুঝেছি শহরের খুব গভীরে থাকে পল্লী, যেখানে শরতের চুম্বন অনুভব করা যায় পুরোদমে। শারদসন্ধ্যায় দিয়াবাড়ির কাশবনে হারিয়ে গিয়ে হঠাৎ যান্ত্রিক শব্দে চমকে ওঠে মানুষ; আকাশ বন পেরিয়ে উড়ে আসছে বিমান। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে অবতরণ করবে রাজধানীর মাটিতে। দিয়াবাড়ির অবারিত অঙ্গনের সৌন্দর্যে নিমজ্জিত হয়ে ভেসে চলুন মেঘে আর আকাশের ওপারে আকাশ থেকে মেঘের পরে মেঘ পেরিয়ে দেশের মানুষকে তার দেশের মাটিতে নিয়ে আসার আগমনী আওয়াজে আরেকবার নেমে আসুন কাশফুলের ঠিক পাদটিতে। সত্যি বলছি, এই শরতে একবার দিয়াবাড়ি বেড়িয়ে আসুন- আমার মতোই দিয়ারবাড়ির নাম বদলে রাখবেন- ‘শরত-বসত’। জনবহুল সড়কে নবিস চালকের ট্রেনিং ঢাকা এখন প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের বাস। এর নগণ্য সংখ্যকই প্রাইভেট গাড়ির সওয়ার অথচ সড়কের সিংহভাগই এসব গাড়ির দখলে। কোটি ঢাকাবাসীর চলাচলের জন্য যেসব গণপরিবহন রয়েছে তার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক এ মহানগরী গড়ে তোলা হয়নি বলে পর্যাপ্ত সড়কও এখানে অনুপস্থিত। গত কয়েক বছরে সরকার সড়কের সংখ্যা বাড়ানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেÑ বিশেষত ফ্লাইওভার নির্মাণ যান চলাচলে সহায়ক হয়েছে। আগামীতে নগরীর মেট্রোরেল হবে, পাতাল রেল হবেÑ ঢাকা বেশ বদলে যাবে। কিন্তু সে তো ভবিষ্যতের কথা। এখন ঢাকাবাসীর হাসফাঁস অবস্থা। যানজটে নাকাল মানুষের বিরক্তি এবং কর্মঘণ্টার ক্ষতি নানা সময়ে খবরের কাগজে উঠে এসেছে। ঘটা করে ট্রাফিক সপ্তাহ পালিত হয়ে থাকে। জনসাধারণ ও যানচালকের ট্রাফিক আইন বিষয়ে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি তথা ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে কিছু অভিযানও পরিচালিত হতে দেখা যায়। কিন্তু বৈধ লাইসেন্সের অধিকারী না হয়েও গাড়ি চালানোর জন্য ক’জন চালককে নিবৃত করা হয়? গণপরিবহনের চালকের হাতে থাকে গণমানুষের জীবন- এটি বরং চাপাই পড়ে থাকে। কত হাজার নবিস চালক ঢাকার রাস্তাকেই তার ড্রাইভিং ট্রেনিংয়ের স্থান হিসেবে দোর্দ- প্রতাপে ব্যবহার করছে তার ওপর কোন প্রতিবেদন দেখি না। যে নবিস চালকটির স্বেচ্ছাচারী চালনায় আমার মতো কেউ শয্যাবন্দী হয়ে পড়ছেন, কারওবা চিরশয্যা পাততে হচ্ছে বাসের নিচে- সেই নবিস চালকদেরই শুধু দুষব আমরা? একটা সংসার চালানোর জন্য তরুণ-নবীন-যুবা তড়িঘড়ি হাতে তুল নিচ্ছে স্টিয়ারিং আর অন্য পিঠে সেই তারই জন্য কত না সংসার বিপন্ন আর এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এখানে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোথায়? যে দফতর নিয়ম বহির্ভূতভাবে দেদার লাইসেন্স দিয়ে চলেছে; যে মালিক গাড়ির চাবিটি তুলে দিচ্ছে আনাড়ির হাতে; যে সংগঠন দোষী চালকের শাস্তি রুখে দিচ্ছে- এদের প্রত্যেকেই প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার নেপথ্যকারিগর, বাকপটু মন্ত্রীর কথা না হয় উহ্যই থাক! ঠিকানা কুড়িগ্রাম বাংলার মাটি কুড়িগ্রাম তাঁর জন্মদাত্রী। মৃত্যু-মুহূর্তে সেই কুড়িগ্রাম আঁচল বিছিয়ে রেখেছিল। কবি সেখানেই শয্যা গ্রহণ করলেন। সৈয়দ শামসুল হকের কথা বলছি। তিনি ছিলেন অনন্য ও ব্যতিক্রম। সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ ও বহুমাত্রিকতার জন্য তিনি অভিধা পেয়েছিলেন সব্যসাচী। এই ঢাকা শহর তাঁর যৌবনের শক্তি দেখেছিল, লন্ডনও পেয়েছিল তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয়। এই তো সেদিন ঢাকার একটি আরোগ্যশালায় হাতের ৪টি আঙ্গুল তুলে বলেছিলেন- এক সঙ্গে চারটি নাটক তার করোটিতে রয়েছে। লালনের মতো তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন ১১৭ বছর। জীবনদীপ নিভে যাওয়ার আগে সলতে উসকে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের পরিকল্পনা ছক আঁকছেন। আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম কষ্টব্যাধি বুঝি পরাস্ত হলো সব্যসাচীর কাছে। আধুনিক মনস্ক, সৃষ্টির তাড়নায় সারাক্ষণ টগবগে তরুণের মতো তাঁকে উদ্দীপিত দেখে সাহিত্যকর্মীরা প্রেরণা পেতেন, তাই অকস্মাৎ প্রস্থানে আমরা বিমূঢ় হয়ে পড়েছি। দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্ধারিত ব্যক্তিগত বিশেষ দিনের আনন্দ আয়োজন তৎক্ষণাৎ স্থগিত করে দিলেন। রাষ্ট্রপতি এলেন জাতীয় শহীদ মিনারে কবিকে অভিবাদন জানাতে। নিকট অতীতকালে আর কোন সাহিত্যিকের প্রস্থানের বেলায় জনতার এমন ঢল নামেনি ঐ পবিত্র প্রাঙ্গণে। কিন্তু হায় কতিপয় অর্বাচীনের মূঢ়তায় রুচিবান মানুষ আহত হলেন। এই অভব্যতা চলে আসছিল সেপ্টেম্বরের শুরুতে লন্ডনে চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে সৈয়দ হক দেশে ফিরে আসার পর থেকেই। মৃত্যুর কিনারে পৌঁছানো সব্যসাচী, মৃত্যুর পর নিজ মাটিতে শষ্যা গ্রহণের আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর উদ্দেশ্যে কটুবাক্য ছুড়ে দেয়া হীন মানসিকতাকে ঘৃণা জানাতেও আমাদের অরুচি হয়। একজন সাহিত্য স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মই তাঁর প্রধান পরিচয়। তাঁর নাটক এবং কাব্যনাটকের তুলনা কি মেলে এই বাংলায়? কুড়িগ্রামে আজ কুঁড়ি ফুটছে অজস্র অঢেল ভালবাসার। কুড়িগ্রাম কোন আগন্তুক গ্রাম নয়, সেটি বাংলাদেশেরই হৃদয়। ১ অক্টোবর ২০১৬ Smasufreisham 71 @ gmail.com
×