ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ ডিজিটাল বিশ্বে বাংলা ও তার সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

একুশ শতক ॥ ডিজিটাল বিশ্বে বাংলা ও তার সঙ্কট

॥ এক ॥ বিশ্বের ভাষা ব্যবহারের হিসাবটি এরকম। উইকিপিডিয়ার হিসাবে ২০১০ সালের তথ্য অনুসারে ম্যান্ডারিনে কথা বলে ৯৫.৫০ কোটি, (সকল চীনা ভাষা মিলিয়ে ১১২ কোটি) স্প্যানিস ৪৭ কোটি, ইংরেজী ৩৬ কোটি, আরবী ২৯.৫০ কোটি, হিন্দী ২৬ কোটি, পর্তুগীজ ২১.৫ কোটি এবং বাংলায় ২০.৫ কোটি লোক কথা বলে। কিন্তু এই হিসাবটি আমার কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। আমার মতে বাংলার হিসাবটা সঠিক নয়। বাংলাদেশের ১৫ কোটি, পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরার ১৪ কোটি, ভারতের অন্যান্য রাজ্যে আরও প্রায় ১ কোটি, এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার অনেক দেশ মিলিয়ে আরও প্রায় ৫ কোটি; সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষার নাম বাংলা। আমাদের হিসাবে বাংলা বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। আমরা যে চীনা ভাষাকে ছাড়াতে পারব না সেটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ার কারণে এই শতকের শেষে বাংলা ভাষা যে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে পৌঁছাবে সেই বিষয়ে সন্দেহ থাকার কোন অবকাশ নেই। হিসাবটি খুবই সহজ। ইংরেজী মাতৃভাষা এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তেমন বাড়বে না যেমনটা বাংলা মাতৃভাষা যাদের তাদের সংখ্যা বাড়বে। হয়ত ইংরেজী ব্যবহারকারীর সংখ্যা আরও বাড়বে। কারণ আমাদের যাদের বাংলা মাতৃভাষা তারাও হয়ত ব্যাপকহারে ইংরেজী ব্যবহার করব। এজন্যই ভাষার ব্যবহারকারী ও ভাষা মাতৃভাষা এই দুটি গোষ্ঠীর মাঝে বিস্তর ফারাক আছে। দুনিয়ার কোটি কোটি লোকের মাতৃভাষা ইংরেজী না হলেও তারা এর ব্যবহারকারী তো বটেই। বাংলা ভাষার এই অবস্থান লিপির দিক থেকে আরও শক্তিশালী। কারণ, বাংলা ভাষা ছাড়াও অহমিয়া, মনিপুরী, নাগা, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি ভাষাও বাংলা লিপি ব্যবহার করে। প্রাচীন ভারতীয় ভাষা পরিবারের প্রাচ্য ধারার বাংলা ভাষা আবার ভোজপুরিয়া, মাগ্ধী, মৈথিলী, উড়িয়া এবং অহমিয়া সহোদরাও। সেইসব ভাষাতেও বঙ্গলিপি বা এর কাছাকাছি লিপি ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতার্থে বাংলা দক্ষিণ এশিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাধিক মানুষের মাতৃভাষা ও লিপি। এই ভাষার কেবল যে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীটাই রয়েছে তাও নয়, এর রয়েছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। লিপির দিক থেকে চীনা ও রোমান হরফের পরই বঙ্গলিপির অবস্থান বলে আমি মনে করি। যদি আমরা সকল ধরনের ব্যবহারকারী এবং মূল ভাষার সঙ্গে এর শাখা-প্রশাখাও যুক্ত করি তবে বাংলার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ষষ্ঠ/৭ম অবস্থানে নয়, আরও ওপরে ঠাঁই পাবে। এরই মাঝে জাতিসংঘের প্রস্তাবিত অফিসিয়াল ভাষার তালিকায় নাম রয়েছে বাংলার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এই প্রস্তাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাও বাংলাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষার মর্যাদা দাবি করেছে। এই দাবি পূরণটি এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। এরই মাঝে জাতিসংঘ এই বিষয়ে একটি শুনানিও করেছে। যদি একেবারে সাধারণভাবে আজকের প্রেক্ষিত দিয়ে বাংলা ভাষা ও এই ভাষাভাষীদের অবস্থানকে বিশ্লেষণ করা হয় তবে তেমন হতাশার চিত্র আমরা খোঁজে পাব না। হতে পারে, আমাদের অনেক স্বপ্নই যথাসময়ে পূরণ হয়নি। কিন্তু আমরা যে আমাদের বহমান দারিদ্র্য, দুর্বল অর্থনীতি, অস্থির ও অপরিপক্ব রাজনীতি নিয়ে পেছনে যাচ্ছি, তাতো নয়। বরং ’৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলা ভাষা সামনেই এগিয়েছে। পেছনে যায়নি। যদিও আমরা অনেকের কাছেই শুনি যে, ইংরেজী ভাষা এবং লাতিন বর্ণ ছাড়া সারা দুনিয়ার নাকি মুক্তি নেই, তবুও বিপরীত চিত্রটিও এখন দেখা যাচ্ছে। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে ব্যক্তিজীবন পর্যন্ত সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রসারিত হয়েছে। কাগজ ও ডিজিটাল মিডিয়ায় বাংলার ব্যবহার ও ব্যবহারকারী দুই বেড়েছে। আমাদের সাহিত্যের ও মিডিয়ার পরিধিও বেড়েছে। আমাদের বাংলাদেশের সরকারী কাজের সবই বাংলা ভাষায় করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নিম্নমান সহকারী পর্যন্ত সকলেই বাংলা ভাষাতেই তাদের প্রশাসনিক কাজ সম্পন্ন করেন। তারা প্রস্তাব এবং সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বাংলা ভাষাতেই। আমাদের নিম্ন আদালত, সরকারী ব্যাংক, সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড, পুলিশ সকলেই বাংলাতেই তাদের কর্মকা- পরিচালনা করেন। এমনকি সেনাবাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলায় সামরিক কমান্ডও দিচ্ছেন। এক সময়ে মনে করা হতো, বাংলা ভাষা সামরিক কাজের উপযোগী নয়। ইংরেজীতে কমান্ড না দিলে নাকি জোশ পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীসহ আধা সামরিক বাহিনীসমূহ বাংলা কমান্ড সাফল্যজনকভাবে ব্যবহার করে সেই ধারণাকেও ভুল প্রমাণ করেছে। এটি আমরা গর্ব করতে পারি যে, বিশ্বের আর কোন দেশ বা আর কোন জাতি বাংলা ভাষাকে এই মর্যাদা প্রদান করেনি। সুতরাং আমাদের এই সাফল্য বুক ফুলিয়ে বলার মতো। আমি একথা বলব না যে, অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বা প্রয়োগের কোন সঙ্কট নেই। সে বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। কিন্তু আমাদের এই সাফল্যকে আমি বড় করেই দেখতে চাই। বিশেষ করে ১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সার্বিক সুযোগ তৈরি হওয়ার পর বাংলাদেশের অফিস আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। একইভাবে বেড়েছে বাংলা পত্র-পত্রিকা-সাময়িকীর প্রকাশনা, পাঠক সংখ্যা এবং প্রকাশনায় এসেছে চমৎকার উজ্জ্বলতা। আমাদের একুশের বইমেলা দেখলে খুব সহজেই এটি অনুভব করা যায় যে, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কম নয়। বাংলাদেশে প্রকাশিত বইগুলোকেও আর একটি প্রাদেশিক অঞ্চলের প্রকাশনা হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা যায় না। এমনকি সারা দুনিয়াতে যেখানেই বাঙালী রয়েছে সেখানেই বাংলা প্রকাশনা, ভাষা ও সাহিত্যচর্চা এবং বাঙালী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছে। আমি অবাক হইনি যে, খোদ ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে এখন ভাষা আন্দোলন হচ্ছে। সুনীল গাঙ্গুলীর মতো মানুষ সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনকি আমরা যখন বার বার ইংরেজী শেখার তাগিদ পাচ্ছি, তখনও বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ এবং বাংলা শেখার প্রতি আমাদের আগ্রহ কমেনি। আমি অবাক হয়েছি এটি দেখে যে, এমনকি বিদেশীরা পর্যন্ত এখন বাংলা ভাষা ব্যাপকভাবে শিখছে এবং চর্চা করছে। তাদের আগ্রহ আমাদের অভিভূত করার মতো। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর মনসুর মুসা মনে করেন যে, এটি আরও বাড়বে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে বিদেশীরা আরও ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষা শিখবে। আমি ৎসুয়সি নারা নামক একজন জাপানী প-িত, যিনি জাপানের প্রফেসর এমিরেটাস, তাকে বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপির ওপর গবেষণা করতে বাংলাদেশ সফরে আসতে দেখে স্তম্ভিত হয়েছি। ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পুরো দেশ সফর করে গেছেন। পুথি এবং পা-ুলিপি ঘেঁটে তিনি খুঁজে দেখছেন, বাংলা লিপির ভিন্নরূপগুলো কেমন করে তৈরি হলো। বাংলা ভাষার প্রতি এই আগ্রহের অন্যতম কারণ হলো যে, তিনি মনে করেন, বাংলা বিশ্বের কেবল যে চতুর্থ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষা, তাই নয়, এটির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। অন্যদিকে বাংলা ভাষায় এখন বিপুলসংখ্যক দেশী-বিদেশী টিভি চ্যানেল অবিরাম বাঙালীর ভাষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি, সরকার, জনগণ ও জনপদের ওপর অনুষ্ঠান প্রচার করছে। বাংলাদেশের বাংলা চ্যানেলের সংখ্যা অনেক। ভারতেও দূরদর্শন ছাড়াও আলফা, একুশে, তারা, স্টার ইত্যাদি বেশ কয়েকটি বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেল জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাদের সম্প্রচার অব্যাহত রাখছে। এমনকি আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্যেও বাংলা টিভি এবং রেডিও খুবই জনপ্রিয়। সার্বিকভাবে যদি আমরা হিন্দী বা অন্য কোন ভারতীয় ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার তুলনা করি, তবে বাংলা ভাষাকে ছোট করে দেখার মতো অবস্থা মোটেই নেই। বাংলা সিনেমার হয়ত সেই সোনালী দিন নেই। সেই অর্থে ইংরেজী আর হিন্দী ছাড়া অন্য কোন ভাষার চলচ্চিত্রই এখন আর আগের মতো তাকত নিয়ে চলতে পারছে না। কিন্তু টিভি মিডিয়া সিনেমার সেই শূন্যতাকে ব্যাপকভাবে পূরণ করছে। এই নিবন্ধের শুরুতে আমরা বাংলা ভাষা ও লিপির সাফল্য এবং সম্ভাবনার কথা বলেছি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বাংলা ভাষার কোন সমস্যা নেই। এই বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর সকল মাতৃভাষাকেই ইংরেজীর মতো দানবের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। বিশে^র ৭২টি দেশের রাষ্ট্রভাষার এই দাপটকে ছোট করে দেখার নয়। ইংরেজীর ব্যবহারিক প্রয়োগ, এর জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা হওয়ার যোগ্যতা, বাণিজ্যিক ভাষা হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং কম্পিউটারের ভাষা হওয়ার যে দক্ষতা এর রয়েছে তার ফলে বিশ্বের অন্য সকল ভাষা থেকেই ইংরেজী এগিয়ে আছে। তাতেও আমি আশা করি, আমাদের পাঠকরা জানেন যে, ইংরেজী পৃথিবীর এক নম্বর মাতৃভাষা নয়। এই ক্যাটাগরিতে প্রথমে রয়েছে চীনা ভাষা। চীনা ভাষায় এখন কথা বলে ১৩৭ কোটি মানুষ। ইংরেজী ভাষাভাষীর সংখ্যা হলো ১২৬ কোটি। ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত ইন্টারনেটে ইংরেজীর ব্যবহার সর্বোচ্চ ছিল। এই হিসাবে বিশ্বের ৫৩.৬৬ কোটি লোক ইংরেজী ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে। অন্যদিকে বিশ্বের প্রায় ৪৪.৪৯ কোটি লোক চীনা ভাষা ব্যবহার করে। কিন্তু ২০০০ থেকে ২০১১ সালের হিসাব দেখলে বোঝা যাবে যে, চীনা ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ১৪৭৯ ভাগ। অন্যদিকে ইংরেজী ভাষার ব্যবহারকারীর পরিমাণ বেড়েছে শতকরা মাত্র ৩০১ ভাগ। http:/ww/w.internetworldstats.com/stats7.htm ফলে ধারণা করা যায় যে, ইন্টারনেটে ইংরেজী ব্যবহারকারীর একচ্ছত্র দাপট আর খুব বেশি দিন থাকবে না। অন্যদিকে ২০১৪ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশেরই প্রায় সাড়ে চার কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এদের অনেকেই বাংলা ব্যবহার করে। ফলে একসময়ে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বাংলা ভাষা এখন ইন্টারনেটেরও একটি বহুল ব্যবহৃত ভাষা। ঢাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net,www.bijoydigital.com
×