
ছবিঃ সংগৃহীত
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির চলমান অবস্থা, এর কারণ এবং করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু করে মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা কমেছে, তবুও তা গড়ে ৯ শতাংশের উপরে ছিল। এই মূল্যস্ফীতির অন্যতম চালক হয়েছে খাদ্যদ্রব্যের দাম। বিশেষ করে চলতি অর্থবছরে বন্যার কারণে উৎপাদন হ্রাস এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
তিনি উল্লেখ করেন, বাজারে কার্টেলের প্রভাব, আমদানি ব্যয়ের বৃদ্ধি এবং দুর্বল সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়েছে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে মূল্যস্ফীতির দিক থেকে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি উভয়ই শহরের তুলনায় বেশি, যদিও শহরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি।
খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি
সিপিডি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে ২০১৯ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত চাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, চিনি, ও মাংসের দাম ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
চালের দাম: ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্রমাগত বেড়েছে, বন্যার কারণে ২০২৪-এ তা আরও বৃদ্ধি পায়।
ভোজ্যতেল: আমদানি-নির্ভর এ পণ্যের দামও ২০১৯ থেকে বেড়ে এসেছে, যদিও মাঝে মাঝে সরকার কর কমিয়ে দাম কমানোর চেষ্টা করেছে।
চিনি: ২০২৩ থেকে ২০২৫-এর মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র কয়েকটি বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, ফলে কার্টেলের প্রভাব এখানে স্পষ্ট।
মাংস: ব্রয়লার মুরগির দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকলেও গরুর মাংস ও দেশি মুরগির দাম অনেক বেড়েছে।
মুদ্রানীতি ও কাঠামোগত দুর্বলতা
ড. ফাহমিদা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে এবং নীতি সুদহার ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে কাঠামোগত দুর্বলতা এবং বাইরের বিভিন্ন প্রভাবের কারণে এ নীতি পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না।
সিপিডি একটি পরিসংখ্যানভিত্তিক মডেল (ভেক্টর অটো রিগ্রেশন) ব্যবহার করে দেখিয়েছে, মুদ্রার সরবরাহ ও ভোক্তা মূল্যসূচকের মধ্যে একটি ইতিবাচক কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ মুদ্রার জোগান বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। ২০২৩ সালে সরকার যে বিপুল পরিমাণ অর্থ (৭০ হাজার কোটি টাকা) বাজারে ছেড়েছে, সেটিও মূল্যস্ফীতিকে তীব্র করেছে।
নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব মাত্র ৩.২ শতাংশ, যা যথেষ্ট নয়।
ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস ও করণীয়
ড. ফাহমিদা জানান, ২০১২ থেকে ২০২৫ সালের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি থেকে কিছুটা কমার সম্ভাবনা থাকলেও, ২০২৬ সালের মার্চ-জুন সময়ে তা আবার বেড়ে যেতে পারে। এর পেছনে মৌসুমি (seasonal) কারণ যেমন কৃষিপণ্য ঘাটতি ও রমজানের চাহিদা বৃদ্ধিই দায়ী।
নীতিগত সুপারিশ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তিনি যে সুপারিশগুলো তুলে ধরেন:
- মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বয়
- বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
- প্রতিযোগিতা আইন ও কমিশনকে শক্তিশালী করা
- শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করা
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা
- বাজারে সরবরাহ বাড়ানো ও কার্টেল ভাঙার জন্য কঠোর পদক্ষেপ
তার মতে, শুধু মুদ্রানীতি নয়, সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাই এই সংকট মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে।
মারিয়া