
.
দেশের বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের উচ্চমূল্যের সেবা নেওয়া প্রায় অসম্ভব। অসুস্থতায় তারা ছুটে যান সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে থাকে রোগীর দীর্ঘ লাইন। অনেক হাসপাতালে ভোর গিয়েও লাইনে দাঁড়াতে হয়। বেশিরভাগ হাসপাতালের আউটডোরে বেলা একটা-দেড়টার মধ্যে রোগী দেখা বন্ধ হয়ে যায়। লাইনে থাকা অনেক রোগীকেই বিনা চিকিৎসায় ফিরে যেতে হয়। আর এরাই ভিড় করেন বিকেলে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে অনুশীলনকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারে। কিন্তু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন যাদের কাছে দিনে অন্তত দেড়শ’ থেকে দুইশ’ রোগীর ভিড় হয়। ফলে এসব চিকিৎসকের একটি সিরিয়াল পেতে কেটে যায় মাসের পর মাস। এমনকি সিরিয়াল পাওয়ার আগেই মারাও যায় অনেক রোগী।
হবিগঞ্জের সাগুফতা মোদক। গত বছরের মার্চে ৬০ বছর বয়সে প্রথম মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের (ব্রেইন স্ট্রোক) শিকার হন। পরিবার থেকে সিলেটে নিয়ে চিকিৎসক দেখানো হয়। এ সময় তারা জানতে পারেন রাজধানীতে নিউরো সম্পর্কিত রোগের জন্য একজন বিখ্যাত চিকিৎসক রয়েছেন। যার হাতের ছোঁয়াতেই রোগী ভালো হয়ে যায়। সেই থেকে এই চিকিৎসকের খোঁজ নিতে শুরু করেন সাগুফতা মোদকের ছেলেমেয়েরা। জানতে পারেন একটি সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালেও রোগী দেখেন তিনি। সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ এবং জনাকীর্ণ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে গত বছর মে মাসে বেসরকারি হাসপাতালেই আসেন সেই চিকিৎসকের সিরিয়াল নিতে। কিন্তু এসেই তো আক্কেল গুড়ুম! নভেম্বরের আগে বিখ্যাত এই চিকিৎসকের কোনো সিরিয়াল ফাঁকা নেই। মাকে দেখাতে হলে নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে কোনোভাবেই দেখানোর সুযোগ নেই জানতে পেরে দিশেহারা যখন পরিবারের লোকজন তখনই হাসপাতালটির তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মী পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, ভাই কিছু টাকা-পয়সা খরচ করেন। এই মাসের মধ্যেই রোগী দেখানোর ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু কেন এত রোগী এই চিকিৎসকের কাছে এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি।
এর উত্তর পাওয়া গেল হাসপাতালটি সরেজমিন পরিদর্শনে। এতক্ষণ যেই চিকিৎসকের কথা বলা হচ্ছিল তিনি স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এই চিকিৎসকের হাতযশের কথা এমনভাবে দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন শত শত রোগী ভিড় করেন এই চিকিৎসকের চেম্বারে। নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালের বহির্বিভাগেও এই চিকিৎসককে দেখাতে প্রতিদিন ৯০০ থেকে ১ হাজার রোগী আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ওখানে যারা দেখাতে পারেন না তারা ভিড় করেন রাজধানীর মগবাজারের এসপিআরসি হাসপাতালে। ফলে প্রতিদিন অন্তত : দুই থেকে তিনশ’ রোগী সিরিয়াল নিতে ভিড় করে করেন এখানে। বিকেল ৫ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই চিকিৎসক এখানে রোগী দেখেন। মাঝখানে নামাজ বিরতি ২০ মিনিট। সব মিলিয়ে ২২০ মিনিটে গড়ে একেকজন রোগীকে ৫ মিনিট করে সময় দিলেও দিনে ৫৬ জন রোগী দেখা সম্ভব। সেই জায়গায় প্রতিদিন অন্তত : দুইশ’ রোগীকে দেখতে হয় এই চিকিৎসককে। তা কিভাবে সম্ভব এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন না সংশ্লিষ্ট কেউই।
একই অবস্থা দেখা যায়, রাজধানীর গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতালের নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের চেম্বারের সামনেও। তিনি প্রত্যেক রোগীকে যথেষ্ট সময় দিয়ে এবং আন্তরিকতা দিয়ে দেখলেও রোগীর ভিড় এত বেশি থাকে যে দিশেহারা অবস্থা দেখা যায় তার চেম্বারের বাইরে অবস্থানকারী সহকারীদের। অনেক রোগীর স্বজনদের কাতর অনুরোধ থাকে। তাদের বেশিরভাগ রোগীই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো থেকে শুধু চিকিৎসকের সুনাম শুনে একবার দেখাতে এসেছেন। এত রোগীর চাপে কবে সিরিয়াল পাবেন তা জানেন না অনেকেই। তবে সবাই একবার হলেও নিজের নাক, কান, গলার সমস্যা এই চিকিৎসককেই দেখাতে চান।
এমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুতে মূল অভিযুক্ত ডা. সংযুক্তা সাহার ক্ষেত্রেও। বগুড়ার বড়গোলার বাসিন্দা সন্তানপ্রত্যাশী মেহেদি হাসান ও আফরোজা খানম প্রায় তিন মাস যাবত চেষ্টা করেও একবারের জন্যও সিরিয়াল পাননি এই দম্পতি। শুধু এই দম্পতিই নন, এমন অনেক নিঃসন্তান দম্পতিও ডা. সংযুক্তা সাহার সুখ্যাতি শুনে প্রতিদিন ভিড় করেন রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে। তিনি প্রতিদিন অন্তত : দেড় থেকে দুইশ’ রোগী দেখতেন বলে অভিযোগ করেছে খোদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও, যা কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে বিস্ময় রয়েছে খোদ চিকিৎসকদের মনেও।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, আমি যখন নিয়মিত রোগী দেখতাম তখনো রোগীদের এমন চাপ থাকত। আমরা চাইলেও কোনো রোগীকে ফেরাতে পারি না। আমার কাছে যে রোগীটি একটু সুস্থতার আশায় আসে তাকে কিভাবে ফেরাই? এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সময়। রোগীর তুলনায় চিকিৎসক স্বল্পতার কারণেই একজন চিকিৎসকের ওপর চাপ পড়ছে। এমন অনেক রোগীকেই মাসের পর মাসও অপেক্ষা করতে হয় সিরিয়ালের জন্য। রোগীরা তো এক্ষেত্রে অসহায়ই। তবে রোগীদেরও এটা বুঝতে হবে। বর্তমানে শুধু রাজধানীতেই নয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই চিকিৎসাসেবার প্রসার ঘটেছে। মেধাবী চিকিৎসকরা রয়েছেন। তারাও খুব ভালো চিকিৎসা করেন। তাই শুধু ‘হাইপের’ ওপর বা কারও কথার ওপর নির্ভর করেই একজন নির্দিষ্ট চিকিৎসকের ওপর নির্ভর না করে যেনো চিকিৎসাসেবা নিতে নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রথমে দেখান। তারা রেফার করলেই যেন সেই সুনির্দিষ্ট চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। নয়তো এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কঠিন।
এর জন্য রেফারেল পদ্ধতি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এর সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, চিকিৎসাসেবা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় হাসপাতাল-চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে মেধাবী চিকিৎসক কতজন রয়েছেন সেটা কেউ দেখছেন না। মেধাবী চিকিৎসকের যদি সংকট না হতো তা হলে রোগীরা নির্দিষ্ট একজন চিকিৎসকের ওপর নির্ভরশীল হতো না। আর চিকিৎসকদেরও সুপারম্যানের মতো ৫ ঘণ্টায় দেড়শ’ থেকে দুইশ’ রোগী দেখতে হতো না। তিনি বলেন, সম্প্রতি সরকারি হাসপাতালগুলোতে বৈকালিক চেম্বার চালু হয়েছে। কিন্তু প্রচারণার অভাবে সেখানে আশানুরূপ রোগী হচ্ছে না। এই চেম্বারগুলোতেও রোগী বাড়ানো গেলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আমি মনে করি।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, এমন পরিস্থিতির অন্যতম কারণ প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবার স্বল্পতা। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার গত বছরের ৩০ মার্চ জেলা পর্যায়ের ১২টি এবং উপজেলা পর্যায়ের ৩৯টি হাসপাতালে পরীক্ষামূলকভাবে বৈকালিক চেম্বার বা স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু করে। যথেষ্ট প্রচার না থাকায় এখানে রোগীর উপস্থিতি তেমন একটা না হওয়া সত্ত্বেও আরও ১৩২টি সরকারি হাসপাতালে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস বা বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করে সরকার। এর মধ্যে ঢাকার চারটি বিশেষায়িত হাসপাতালও আছে। এগুলো হলো ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিকস হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এখন পর্যন্ত দেশের মোট ১৮৩টি সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে।
কিন্তু এসব চেম্বারে রোগী আসছে নামেমাত্র। জনকণ্ঠের দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ, নাটোর, ঝিনাইদহ, জামালপুর, নওগাঁ, ময়মনসিংহসহ কয়েকটি জেলা-উপজেলার পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, বেশিরভাগ হাসপাতালেই বৈকালিক চেম্বারে রোগীদের উপস্থিতি সংখ্যা খুবই কম। আবার কোথাও রোগীশূন্য দেখা গেছে। এ ছাড়াও সরকারের নতুন দফায় দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেক হাসপাতালে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধই রাখা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্বল্প ব্যয়ে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা শুরু হলেও প্রচার-প্রচারণা কম হওয়ায় মানুষের না জানার কারণে রোগীদের উপস্থিতি কম। তবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া বৈকালিক সেবা শুরু করায় প্রশ্ন তুলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভালো উদ্যোগ হলেও পর্যাপ্ত জনবল সংকট, সঠিক পরিকল্পনা প্রহণ না করে এবং অবকাঠামো ঠিক না করে এ ধরনের পদক্ষেপ মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রভাব পড়তে পারে ভবিষ্যতের জন্য নেওয়া অন্য প্রকল্পগুলোতেও।
সরকারের গত মেয়াদে ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে বৈকালিক চেম্বার বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে ৩০ মার্চ সচিবালয় থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ পাইলট প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তিনি। প্রাথমিকভাবে দেশের ১২টি জেলা সদর হাসপাতাল এবং ৩৯টি উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালে স্বল্প ব্যয়ে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলা ও উপজেলার সরকারি হাসপাতালে চালু করা হবে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাস পেরিয়ে গেলেও বৈকালিক চেম্বার প্রকল্প নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনা শোনা যায় নি। ফলে বেসরকারি হাসপাতালেই বিকাল বেলায় এসব সুপারম্যান চিকিৎসকদের চেম্বারে ভিড় করছেন রোগীরা।