
রাজধানীতে প্রবল বৃষ্টির পর শুক্রবারও নিউ মার্কেট এলাকায় ছিল জলাবদ্ধতা
রাতভর টানা ভারি বৃষ্টিতে কার্যত ঢাকা শহর অচল হয়ে পড়ে। প্রধান প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সবখানে কোমর পানি। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর নিউমার্কেট, নিউ সুপার মার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, কুয়েত মৈত্রী হল, ফজিলাতুন নেছা মুজিব হল, শাহনেওয়াজ হল, ঢাকা কলেজসহ বহু এলাকা এখনো পানিতে ডুবে আছে। অনেক এলাকা হাঁটুপানিতে ডুবে থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা। হাঁটু পরিমাণ জলাবদ্ধতা থাকায় নিউমার্কেট ও নিউ সুপার মার্কেট বন্ধ ছিল।
সেখানে দোকানে পানি ঢুকে যাওয়ায় অনেককে দোকান থেকে মালামাল সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। এ ছাড়া অন্যান্য এলাকার সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে যানবাহন চলাচল কম ছিল। কোথাও কোথাও পানিতে আটকে ছিল যানবাহন। শুক্রবার রাজধানীবাসীর সীমাহীন ভোগান্তিতে দিন কেটেছে। এদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কুইক রেসপন্স টিম জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে। তবে নামছে না গুরুত্বপূর্ণ মার্কেট, সড়ক ও অলিগলির পানি।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, বৃহস্পতিবার রাত থেকে ৬ ঘণ্টায় ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এতে রাজধানীতে বিভিন্ন এলাকায় জলবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে রাজধানীর হাতিরঝিল, আজিমপুর, নিউ পল্টন, ধানম-ি, মিরপুর, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট যেতে নতুন রাস্তা, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, মোহাম্মদপুরের কিছু অংশ, গুলশান লেকপাড় এলাকা, মালিবাগ, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকা, শান্তিনগর, সায়েদাবাদ, পুরান ঢাকার শনির আখড়া, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, এলাকার সংযোগ সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
শুক্রবার বিকেলে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর নিউমার্কেট, নিউ সুপার মার্কেটের ভেতরে ও বাইরে কোমর পরিমাণ পানি। এই কারণে দু’টি মার্কেটই বন্ধ ছিল। অল্পসংখ্যক ব্যবসায়ী, যারা দোকান খুলেছেন, তারা মূলত এসেছেন দোকানে পানি উঠেছে কি না দেখতে। মার্কেটের ভেতরের অংশে শুক্রবার সন্ধ্যায়ও পানি ছিল। এ ছাড়া এক নম্বর গেট ও পাঁচ নম্বর গেটের সামনের সড়ক পানিতে তলিয়ে আছে।
নিউমার্কেটে অগ্রণী বেডিংয়ে মালিক নূরন্নবী জনকণ্ঠকে জানান, সরকারি ছুটির দিন শুক্রবার নিউ মার্কেট এলাকায় ব্যবসার দিন। অথচ রাতভর বৃষ্টিতে মার্কেটের সামনে কোমর পানিতে তলিয়ে আছে। শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এখনো পর্যন্ত মার্কেটের সামনে ও এর চার পাশে পানি জমে আছে। দোকান খোলা তো দূরের কথা হাঁটাচলাই করা যাচ্ছে না। নিউমার্কেটের আরেক ব্যবসায়ী বাবু জানান, প্রবল বৃষ্টিতে রাতে সব মাল উঁচু করে রেখে গেছি। সকালে এসে দেখি পানি আরও বেড়েছে। দোকানের ক্যাশ বাক্স প্রায় ডুবে গেছে। অনেক কাপড় ভিজে গেছে। পাশের এক বই দোকানি জানান, অন্তত এক হাজার বই ভিজে গেছে। যেন বন্যা হয়েছে নিউমার্কেটে। সেখানকার বাইরের ফুটপাতে ব্যাগের দোকান চালান খলিলুর রহমান। তিনি জানান, শুক্রবার নিউ মার্কেট এলাকায় কেনাবেচা বেশি হয়। জলাবদ্ধতার কারণে মার্কেট বন্ধ। দোকান খোলা তো দূরের কথা হাঁটাচলা করাই যাচ্ছে না। বেচাকেনা না করলে খাব কি?।
মিরপুর কল্যাণপুর থেকে কেনাকেটা করতে এসেছেন মিলি। তিনি জানান, শুক্রবার অফিস বন্ধ থাকায় বাসায় প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনতে এসেছিলাম। এসে দেখি মার্কেটের কোমর পরিমাণ পানি। এখনো সরেনি। দোকানপাট বন্ধ, তাই বাসায় চলে যাচ্ছি। বড় মগবাজার থেকে কেনাকাটা করতে নিউমার্কেটে আসেন রোশনী। এসে দেখেন, মার্কেটের সামনে পানি থৈ থৈ করছে। মার্কেট বন্ধ।
মার্কেট বন্ধ থাকলেও মিরপুর রোডে পানি না থাকায় ফুটপাতের দোকানগুলোতে মোটামুটি ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। ফুটপাতে জুতার দোকানি শাওন মাহমুদ জানান, বেচাবিক্রি নেই। মাত্র চার জোড়া জুতা বিক্রি করেছি। মার্কেটও বন্ধ। লোকজন কম, তাই বেচাবিক্রিও কম।
ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, গ্রিন রোড ঘুরে দেখা যায়, রাতের জলাবদ্ধতা তখনো দূর হয়নি। ঢাকা কলেজ ঘুরে দেখা গেছে, পানিবন্দি অবস্থায় আছেন আটটি ছাত্রাবাসের পাঁচ হাজারেরও বেশি আবাসিক শিক্ষার্থী। এছাড়া রিজার্ভ পানির ট্যাংকও ডুবে গেছে ময়লা পানিতে। শুক্রবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, দুটি খেলার মাঠ, সড়ক ও ছাত্রাবাসের করিডোর পর্যন্ত পানিতে থৈ থৈ করছে। পানির জন্য কেউ ছাত্রাবাস থেকে বের হতে পারছেন না। ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী শাওন জানান, হলে ভেতরে ও বাইরে পানি তলিয়ে গেছে। বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। পুরো ক্যাম্পাসে পানি আর পানি। পানিতে ময়লাও ভাসছে এবং ময়লা হলেও ঢুকে পড়ছে। ডাইনিং বন্ধ। ঢাকা কলেজ উপাধ্যক্ষ এবং ছাত্রাবাস কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এ.টি.এম. মইনুল হোসেন জানান, আমাদের পক্ষ থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য যতটুকু করা সম্ভব তা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ও এর সংলগ্ন ছাত্রী হোস্টেল কুয়েত মৈত্রী হল ও ফজিলাতুন নেছা মুজিব হল ভেতরে ও বাইরে হাঁটু পানি। বৃহস্পতিবার রাতে টানা ভারি বর্ষণের কারণে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কুয়েত মৈত্রী হলে। নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় বিকেল পর্যন্ত পানি নেমেনি। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে থেকে বিদ্যুৎ নেই। ফলে গোসল ও খাওয়ার পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে হলটিতে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, পানি নামানোর জন্য ওয়াসার তিন টিম কাজ করছে। শুক্রবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমান জানান, পানি নিষ্কাশনের জন্য সিটি করপোরেশনের তিনটি টিম কাজ করছে। পানীয় জল পাঠানো হয়েছে। আর আপাতত অস্থায়ীভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী লাবণ্য তাসফী বলেন, এখনো পানি নামেনি, বিদ্যুৎও আসেনি। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই শিক্ষার্থীরা সবাই অসহনীয় অবস্থায় রয়েছে। খাবার পানিও নেই। কিছুক্ষণ আগে ওয়াসা থেকে খাবার পানি এনে সবাইকে দেওয়া হচ্ছে।
আরেক আবাসিক শিক্ষার্থী লিমা আক্তার বলেন, হলে পানি ঢুকে যাওয়ায় সহকর্মীরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে কোথায় যাবে? রাত থেকে যখন পানি বাড়তে শুরু করে তখনো কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। রাত ১১টার দিকে নিচতলার রুমে পানি প্রবেশ করে। এখন আমরা ওপরের তলায় আছি। ওয়াজিহা জাহান জুঁই নামক এক শিক্ষার্থী ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে কুয়েত মৈত্রী হলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে নিচতলা ডুবে গেছে। পানি সিঁড়ির নিচ পর্যন্ত চলে এসেছে। গণরুমে পানি ঢুকেছে। হলের মুদি দোকানের ফ্রিজে পানি ঢুকে শর্ট সার্কিট হওয়াতে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এ সময় তিনি গণরুমের শিক্ষার্থীদের তার নিজের রুমে যাওয়ার অনুরোধ করেন। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংলগ্ন রাস্তায় দেখা যায় মাঝে মাঝে যেন স্রোত বইছে। হলবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো শিক্ষার্থী।
এছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে হাটু পানি। লাশ হিমাগারে রাখা হয়েছে। সকাল থেকে নতুন লাশগুলো ট্রলিতে রাখা হয়েছে।
অপরদিকে দুপুরে আজিমপুর মূল সড়ক ও অলিতে গলিতে পানি জমে ছিল। সিএনজি চালক আলী হোসেন জানান, রাজধানীর মিরপুর থেকে আজিমপুরে একটা ট্রিপ নিয়ে এসেছি। এসে দেখি বিভিন্ন অলিতে গলিতে রাস্তায় এখনও পানি জমে আছে। সিএনজি নিয়ে গেলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে। তাই যাত্রী এখানে নামিয়ে দিয়ে রিক্সা ঠিক করে দিয়েছি। পুরানো ঢাকার বংশাল থানাধীন বাগদাসা লেনে বাসিন্দা আওয়ামী লীগ নেতা মন্টু মিয়া জনকণ্ঠকে জানান, সকালে ব্যক্তিগত কাজে বায়তুল মোকাররম গিয়েছিলাম। তিনি জানান, বাগদাসা লেন থেকে শুরু করে বংশালের প্রধান সড়কসহ অলিগলি এখনো পানিতে থৈ থৈ করছে। দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের কুইক রেসপন্স টিম কাজ করে পানি সরাতে পারছে না। বংশাল পার হওয়ার সময় প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটু পানি মাড়িয়ে আসতে হয়েছে। পরে রিক্সা নিয়ে বায়তুল মোকাররম গেলাম। পুরানো ঢাকার জেলখানা ঢাল থেকে নয়াবাজার পর্যন্ত কোথাও কোথাও হাঁটু পরিমাণ পানি দেখে গেছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) জনসংযোগ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাত থেকেই কুইক রেসপন্স টিম জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে। কোথাও পানি জমে থাকলে ১৬১০৬ নাম্বারে নগবাসীকে ফোন করতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, রাত থেকেই তাদের কুইক রেসপন্স টিম মাঠে কাজ করছেন। এ ছাড়া শুক্রবার সাধারণ ছুটি হলেও তারা তাদের কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করেছেন।
এদিকে রাজধানীর মিরপুরের কুর্মিটোলা পূর্ব বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দারা। দুপুরের দিকে ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমর সমান পানি। ক্যাম্পের বেশিরভাগ ঘরেই পানি জমে রয়েছে। এই অবস্থায় ক্যাম্পের অনেক বাসিন্দা চৌকি বা খাটের ওপর অবস্থান নিয়ে দিন পার করছেন।
বৃহস্পতিবার দিন দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। পরে রাত ৯টার পর নামে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। রাতভর টানা বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পরপর বজ্রপাত। কয়েক ঘণ্টার ভারি বৃষ্টিতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে গোটা রাজধানী। কোনো কোনো সড়ক ও অলিগলিতে জমে যায় কোমরসমান পানি। সড়কে জলাবদ্ধতায় মিরপুরে বিদ্যুৎস্পর্শে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত এক শিশু হাসপাতালে।