
অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পথ
অফিসের সহকর্মীসহ অন্যদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় সোয়া কোটি টাকা সুদে ধার নিয়েছিলেন টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) কনিষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক রকিব উদ্দিন আহম্মেদ লিটন (৪৬)। কিন্তু অনলাইনে জুয়া খেলে তিনি সব টাকা নষ্ট করেন। পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে মেজাজ বিগড়ে থাকত তার। বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন প্রতিনিয়ত। কিছু দিন আত্মগোপনেও ছিলেন। এক পর্যায়ে স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে খুন করেন রকিব। এরপর নিজেও রেললাইনে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। তিনটি খুনের ঘটনার পর থেকে পাগলের বেশ ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। পরে অবশ্য পুলিশের হাতে ধরাও পড়েন তিনি।
চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ধানমণ্ডি লেক থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধারের তদন্তেও মিলেছে অনলাইন জুয়ায় আসক্তির তথ্য। দেশে নিষিদ্ধ হলেও দিন দিন অনলাইন জুয়াড়ির সংখ্যা বেড়েই চলছে। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী থেকে নি¤œ আয়ের সাধারণ মানুষ সর্বনাশা এই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন। জুয়ার কারণে বাড়ছে অপরাধও। জুয়ার এসব ওয়েবসাইট কিংবা অ্যাপ অধিকাংশই পরিচালনা করা হচ্ছে বিদেশ থেকে। সেখানে এসব সাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশের এজেন্টরা। জুয়ায় আর্থিক লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশী মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)।
জনকণ্ঠ গত কয়েকদিন জুয়ার একটি সাইট পর্যালোচনা করেছে যেখানে দেখা গেছে, একসঙ্গে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশী জুয়া খেলছে। এর মধ্যে একজন জুয়া খেলে প্রায় এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা খুইয়েছেন। এক লাখের মধ্যে যদি ১০ শতাংশ মানুষের ১০ হাজার টাকা করে খোয়া যায় তাহলে কী পরিমাণ টাকা চলে যাচ্ছে, তা উদ্বেগের বিষয়। বিভিন্ন জুয়ার সাইট এবং অ্যাপ ভিজিট করে দেখা গেছে, ইমেইল, মোবাইল নম্বর ও পাসওয়ার্ড দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। এসব অ্যাকাউন্টে একটি করে ভার্চুয়াল ওয়ালেট যুক্ত থাকে। এতে অবৈধ কারেন্সি অ্যাড করতে বিভিন্ন এজেন্ট দিয়ে এমএফএসের মাধ্যমে টাকা কনভার্ট করা হয়।
এই অবৈধ কারেন্সিকে বট ব্যালেন্স বলা হয় যা অনলাইনে জুয়া খেলার জন্য সরাসরি ব্যবহার করা হয়। এরপর ফেসবুক আইডি, পেজ, গ্রুপ, ওয়েবসাইট ও মোবাইলভিত্তিক এনক্রিপ্টেড অ্যাপস দিয়ে চালানো হয় জুয়ার এ সাইটগুলো। জুয়ার এসব সাইটের অধিকাংশ পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব সাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশের এজেন্টরা।
নিয়মিত অনলাইনে জুয়া খেলেন এমন একজন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ওয়ানএক্সবেটে জুয়া খেলতাম। প্রথমে নগদ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সাইটে খেলা শুরু করি। এক রাতে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়। পরদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় খেলতে গেলে পুরো টাকা হেরে যাই। পরবর্তী সময়ে ২০ হাজারের মতো ইনভেস্ট করি। সেখানে খেলতে গিয়েও হেরে যাই। বড় অঙ্কের টাকা হেরে গিয়ে পরে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে খেলা শুরু করি। সেখানে অনেক সময় দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত লাভ হয়, আবার অনেক সময় পুরো টাকাই হেরে যাই। এটি নেশার মতো। খেলতে শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত খেলতে ইচ্ছা করে।
টাকা শেষ হলে আবারও টাকা ইনভেস্ট করে খেলা শুরু করতে ইচ্ছা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ অ্যাপগুলো গুগল প্লে স্টোরে পাওয়া যায় না। কারণ বিটিআরসি জুয়ার অ্যাপসগুলো বন্ধ করে রেখেছে। গুগল থেকে সার্চ করে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে অ্যাপস ডাউনলোডের লিংক পাওয়া যায়। ইনস্টল করার পর অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। অ্যাকাউন্ট খোলা খুবই সহজ। শুধু নাম, মোবাইল নম্বর অথবা ইমেইল আইডি দিলেই অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব।’ একটি ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা স্পোর্টস বেটিং সাইট বা অনলাইন জুয়া খেলার বিভিন্ন সাইটের তালিকা, সাইটের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন এবং এ ধরনের সাইটে অ্যাকাউন্ট খোলার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়।
জুয়া খেলার আগে অ্যাপে টাকা দিতে হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। অ্যাপে বিভিন্ন খেলায় জয়-পরাজয় নিয়ে বাজি ধরা যায়। এছাড়া বিভিন্ন গেমস থাকে, তবে সেটা কম মানুষ খেলে। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, জুয়ার সাইটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জড়িতদের এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। আর যারা এরই মধ্যে অপরাধে জড়িয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক জনকণ্ঠকে বলেন, অনলাইন জুয়াড়িরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এ ধরনের লেনদেন করছে। যে কারণে তাদের শনাক্ত করা বেশ কঠিন।
তবে তদারকি ও সতর্কতা বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরিফ মাঈনুদ্দীন বলেন, বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯০ শতাংশের মোবাইল ফোনে এমন (জুয়ার) অ্যাপস পাওয়া যাচ্ছে। বিট কয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সির এ খেলায় দুই ধাপে টাকাগুলো দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। শুরুর দিকে কিছু লাভ দেখিয়ে পরে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রতারকরা সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে বলেও জানান তিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্যে মাঝে মাঝে এসব সাইট বন্ধের উদ্যোগ নেয় বিটিআরসি। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাতেও খুব একটা লাভ হয় না।
দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন জুয়ার সাইট ওয়ানএক্সবেট। এছাড়া ওয়ানএক্সবিট, বেট ৩৬৫ ডটকম, প্লেবেট ৩৬৫ ডটকম, বিডিটি ১০ ডটকম, উইনস ৬৫ ডটকম ও বেটস্কোর২৪ ডটকম, মেলবেট, প্যারিম্যাচ সাইটও বেশ জনপ্রিয়। এরমধ্যে বেট ৩৬৫ ডটকমের বিশ্বজুড়ে গ্রাহকসংখ্যা দেড় কোটি। এগুলোর বিজ্ঞাপন নিয়মিত দেওয়া হয় ফেসবুকে। দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এ সাইটগুলোতে ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলা নিয়ে বাজি ধরা যায়। ক্রিকেটে প্রতি বলে বলে, ম্যাচের প্রথম ওভারের প্রথম বলে, প্রতি ওভারে, প্রতি ম্যাচের প্রথম ছয় ওভার, পরবর্তী ওভারে উইকেট যাবে কি না ও কোন দল জিতবে এমন করে জুয়ার ক্যাটাগরি সাজানো।
এসব সাইটের বেশিরভাগ রাশিয়াকেন্দ্রিক। তবে ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। কিছু দেশী সাইটও রয়েছে। সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে অনলাইন জুয়ার ৩৩১টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। গুগল প্লে স্টোর থেকে জুয়া বিষয়ক অ্যাপ বন্ধের জন্য গুগল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে রিপোর্ট করেছে বিটিআরসি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি অ্যাপ বন্ধ হয়ে গেছে, বাকিগুলো যাচাই বাছাই করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জনকণ্ঠকে বলেন, অনলাইন জুয়া বন্ধে যতটা সম্ভব, চেষ্টা করা হচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা হলো, সাইটগুলো পরিচালিত হয় বিদেশ থেকে। দেশে বন্ধ করা হলে ভিপিএন বা অন্য উপায়ে ঠিকই সাইট ব্যবহার করা হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো-ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন চলছে। এজন্য জনসচেতনতার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি।