
নদীপথ
বাংলাদেশে এক সময় ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ ছিলো। কিন্তু দখল, দূষণে ও ভরাট হয়ে হারিয়ে গেছে ১৮ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে মাত্র ৬ হাজার ১৯২ কিলোমিটার নদীপথে হচ্ছে নৌ-চলাচল। বর্ষার সময় এই নৌ-পথ দৈর্ঘ্য হয় ৭ হাজার ৮৬২ কিলোমিটার। বর্তমান সরকার ১০ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। গত জুন পর্যন্ত ৩ হাজর ৬৯২ কিলোমিটার পথ উদ্ধার করেছে অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
আরও পরুন:ডেঙ্গুতে আরও ১৩ মৃত্যু, হাসপাতালে ১৯৮৩
সংস্থাটির সূত্র জানায়, নদী খননের ৯ টি প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশের ৪৮টি নৌ-পথ সচল করা হয়েছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীন নৌ-পথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ে মৃত ভোগাই-কংশসহ ২৭ রুটে ২ হাজার ৩২০ কিলোমিটার নৌ-পথ সচল করা হয়েছে। এছাড়া ভারত-বাংলাদেশ নৌ-প্রোটোকল রুট সিরাজগঞ্জ-দৈখাওয়া-আশুগঞ্জ-জকিগঞ্জ ২৯০ কিলোমিটার নৌ-পথ, পুরাতম ব্রহ্মপুত্র-তুলাই-পুনর্ভবা ২১৪ কিলোমিটার নৌ-পথ ও গোমতী-শীতলক্ষ্যা-মেঘনা-আড়িয়াল খাঁসহ বিভিন্ন নদী খননের মাধ্যমে ৬৩৭ কিলোমিটার নৌ-পথ খনন করা হয়েছে। এ সব নৌ-পথ খননের মাধ্যমে ৩৬২ লাখ ঘনমিটার মাটি অপসারণ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. রকিকুল ইসলাম তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ ছিলো। যা পাকিস্তান আমলে কমে ১৮ হাজার কিলোমিটারে নেমে আসে। স্বাধীনতার পরে তা আরও কমে যায়। তাই বর্তমান সরকার নৌ-পথ উদ্ধারে মহাপরিকল্পনা গ্রহন করে। এর অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ উদ্ধারের প্রকল্প নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে গত ১৪ বছরে সারাদেশে নদী খননের মাধ্যমে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি নৌ-পথ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া মংলা-ঘষিয়াখালী (এমজি) চ্যানেল ড্রেজিং করে ২০১৫ সালে নৌযান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই চ্যানেল দিয়ে বর্তমানে ১ লাখ ৩৯ হাজার টি ভেসেল (বড় জাহাজ) ৮-১৪ ফুট গভীরতায় চলাচল করছে। নাব্যতা সংকটে খাগদোন, লাউকাঠি, ভোলা নালা, কীর্তনখোলা, ইছামতি, কর্নতলী দিয়ে কার্গো লঞ্চ চলাচল করতে পারত না প্রকল্পে আওতায় ড্রেজিং এর নাব্য ফিরিয়ে এনে এখন সারা বছর চলাচল করছে।
মৃত ভোগাই-কংশে এখন চলছে কার্গো-যাত্রীবাহী লঞ্চ
ভোগাই-কংশ একটি সীমান্ত নদী। নৌ-পথটি দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ কিলোমিটার। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ হতে বারহাট্টা পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সম্পূর্ণ মৃত কংশ নদী। দীর্ঘ থেকে এই নৌ-পথে নৌ-চলাচল বন্ধ ছিলো। নদী খননের মাধ্যমে কংশ নদীসহ গাগলাজোড় থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার নৌ-পথ ২০১৯ সালে সচল করা হয়েছে। অভ্যন্তরীন নৌ-পথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে এই নৌ-পথসহ ২ হাজার ৩২০ কিলোমিটার নৌ-পথ সচল করা হয়েছে বলে অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র জানায়।
প্রকল্প সূত্র জানায়, বর্তমানে কংশ নদীর গাগলাজোড় থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত কার্গো, বড় বড় ট্রলার লঞ্চ চলাচল করছে। ড্রেজিংকৃত মাটি দ্বারা মোহনগঞ্জ পার্ক, জানজিলা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, জানজিলা প্রাইমারি স্কুল, খুলুনজা প্রাইমারি স্কুল, গাগরা প্রাইমারি স্কুল, সাংকারপুর প্রাইমারি স্কুল ইত্যাদি প্রায় ৭০-৮০ টি জায়গায় ভরাট করা হয়েছে। ৫৩টি নৌ-রুটের ১২ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ খননের জন্য প্রথম পর্যায় ২৪টি নদী খনন প্রকল্পের আওতায় এই নৌ-পথটি সচল করা হয়েছে। এছাড়া খাগদোন, লাউকাঠি, ভোলা নালা, কীর্তনখোলা, ইছামতি, কর্নতলী, সুরমা, রক্তি বাউলাই, রক্সা নীলা এবং কংস সহ ১২টি নদী খনন কাজ শেষ হয়েছে। নদী খননের মাটি সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রর নিচু জায়গা ভরাটের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ভোগাই-কংশ নদীটি শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুরা মান্দালিয়া ইউনিয়ন দিয়ে ভোগাই নদী নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর নদীটি মরিচপুড়া ইউনিয়নে ইছামতি ও কংশ নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলার ফুলপুর ইউনিয়নে পুনরায় মিলিত হয়ে কংশ নাম ধারণ করেছে। বর্তমানে ভোগাই নদীর মূল প্রবাহ ইছামতি নদীর গতিপথে প্রবাহিত হয়। নেত্রকোণার বড়হাট্টা উপজেলার বাউশি থেকে নদীটি কাউনাই নাম ধারণ করে ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ ও মোহনগঞ্জ এই তিনটি উপজেলার সংযোগস্থলে ফিনারবাক ইউনিয়নে বাউলাই নদীতে পতিত হয়েছে। শুধু বর্ষাকালে কংশ নদী পথে সামান্য পানি প্রবাহিত হয়। এই গতিপথ বর্তমানে মরা চ্যানেলে পরিণত হয়েছে।
কংশ নদীটি ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুমানগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার ধুবাউড়া ও নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুর যথাক্রমে মালিজি, নিতাই ও সোমেশ্বরী নদী তিনটিতে মিলিত হয়েছে। আবার নেত্রকোণা সদর উপজেলা ও বারহাট্টা উপজেলায় যথাক্রমে ধালাই-বিশনাই ও গুলাম খালী নামে দুইটি নদী উৎপন্ন হয়েছে। বর্তমানে ভোগাই-কংশের মূল প্রবাহ এই দুইটি নদীপথে বেশি প্রবাহিত হয়। ফলে নদীটিতে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহের পরিমাণ কমে যায়। ভাটিতে নদীটির প্রস্থ দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং তলদেশ ভরাট হয়ে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। জারিয়া নামক স্থানে নদীর পারে সুইচ গেট দিয়ে বিলের পানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এক কালে এই অঞ্চলের যোগাযোগ, কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোপুরি এ নদীর উপর নির্ভরশীল ছিল।
এ নৌ-পথে বেশ কিছু ব্যবসা কেন্দ্র অবস্থিত। নৌ-পথ নাব্য না থাকায় এসব ব্যবসা কেন্দ্র সড়ক পথে মালামাল পরিবহন হচ্ছে। ফলে পরিবহন খরচ অনেক বেশি হচ্ছে। নৌ-পথে সার্বক্ষণিক নির্বিঘ্নে কার্গো/নৌ-যান চলাচল অক্ষুন্ন রাখার জন্য ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নৌ-পথটির নাব্য ফিরিয়ে এনে এ অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিআইডব্লিউটিএ’র অভ্যন্তরীন নৌ-পথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হয়েছে। বর্তমানে নদী শুস্ক মৌসুমে ৮-৯ ফুট পানি থাকে।
অস্তিত্ব সংকটে এখনো অর্ধশত নদ-নদী \ নাব্য সংকট, কৃত্রিম বাধার সৃষ্টি, পলি জমা, অবৈধ দখলসহ নানা কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ময়মনসিংহের অর্ধশত নদ-নদী। ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অনেক নদী। বেশিরভাগ নদীর বুকজুড়ে এখন ফসলের ক্ষেত। ময়মনসিংহ জেলার ৪৭টি নদী, উপনদী বা শাখা নদীর উল্লেখযোগ্য অতীত থাকলেও বর্তমান বড়ই করুণ। জেলার প্রধান নদ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র।
এ নদ ঘিরেই ময়মনসিংহ শহরের গোড়াপত্তন। একসময় ব্রহ্মপুত্র নদের প্রশস্ততা ছিল ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার। আজ তা ভরাট হতে হতে স্থানভেদে ১০০ থেকে ২০০ মিটারে ঠেকেছে। শুষ্ক মৌসুমে জল থাকে না, ধূ-ধূ চর জেগে উঠেছে স্থানে স্থানে। নাব্য হারিয়ে শীর্ণ এখন এ নদ। নদটি কোথাও কোথাও এখন একেবারেই ক্ষীণ। হেঁটেই পারাপার হচ্ছে মানুষ।
প্রধান এ নদের পাশাপাশি ময়মনসিংহের ভূমি চিরে বয়ে চলা ঝিনাই, আয়মন, সুতিয়া, বানার, খিরু, ঠাডাকুড়া, ঘরোটা, সিমাহালি, নরসুন্দা, বোখাই, নিতারী, সোমেশ্বরী, কংশ, গুনাই, কাঁচামাটিয়া, পানকুরা, সাইদুল, মগরা, রাংরা, খারমোরী, মহাদেব, যদুকাটা, ধনু, বোয়ালাই, শিরখালি, সিংড়া, চেল্লাখালী, মতিচিক, চালহি, বংশাই, মানস, পুতিয়া, জিনজিরাম, সুবনফিরি, বলেশ্বর, ভোগাই-কংসা, কউলাই, সিলাই, খারমেনি, সাতারখালী, তারাটিয়া, ঘাগটিয়া, ঝগড়াখালী, নবগঙ্গা, মরা নেতাই, বেনিপোড়া, রূপালী, রাঙ্গানিয়া, মেকিয়ারকান্দা, মালিঝি, খড়িয়া, বালুয়া, আনই, আখিল, বাইজানাসহ প্রায় অর্ধশত নদীর অবস্থা খুবই করুণ।
প্রমত্তা আয়মন নদীর তীরে আলেপশাহী পরগনার প্রথম জমিদার গড়ে তুলেন মুক্তাগাছা শহর। ছোট শহরের তিন দিকে এ নদীর চলনপথ। কিন্তু সেই আয়মন নদী ক্রমে খাল হলে এখন বিস্মৃতির পথে হাঁটছে। এখানকার শাখা নদী ঠাডাকুড়ার অবস্থা আরও করুণ। অন্যতম নদী বানার কিংবা সুতিয়া ভরা বর্ষায় সামান্য নড়াচড়া করলেও শুষ্ক মৌসুমে পড়ে থাকে মৃত সাপের মতো। শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোর বুক চিরে নৌকা চলে না বরং থাকে বিস্তৃত ফসলের মাঠ। ব্রহ্মপুত্র ছাড়াও কংশ ও নেতাইকে নদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কংশ নদ ভর বর্ষায় ফুলে ফেপে উঠলেও বাকি সময় জীর্ণ অবস্থা। বিস্তীর্ণ চরে তখন ফসলের সমাহার। ধোবাউড়ার সাতারখালী, তারাটিয়া, ঘাগটিয়া, ঝগড়াখালী, নবগঙ্গা, মরা নেতাই, বেনিপোড়া, রূপালী নদী, রাঙ্গানিয়া, মেকিয়ারকান্দা, নদীগুলোর বর্তমান অবস্থাও একই। বিভিন্ন মৌজার ম্যাপের নদী, হালট, গোপাট, সিকস্তি, আড়ংঘাটায় এখন রয়েছে ফসলের মাঠ, ঘরবাড়ি অথবা নানা গাছপালা। হালুয়াঘাট উপজেলার পাহাড়ি নদী সূর্যপুরডালা। গারো পাহাড়ের পাদদেশ বেয়ে ঝরনার জল, পাহাড়ির ঢল হয়ে নামে এ পথে। এখন সারা বছর অচল। এছাড়া দর্শা, গাঙ্গিনী, বুড়া ভোগাই, মেলং সেওয়াল, পচনধরা, ভোরাঘাট নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে ভরাট হয়ে যায় বলে স্থানীয়রা জানান।
এমএম