ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

ইডেন কলেজ ছাত্রলীগে নতুন সঙ্কট

রিভা-রাজিয়ার বিচার দাবি করা নেত্রীরাই স্থায়ী বহিষ্কার

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

রিভা-রাজিয়ার বিচার দাবি করা নেত্রীরাই স্থায়ী বহিষ্কার

ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীরা রাজধানীর ধানম-ি আওয়ামী লীগের সভাপতির কার্যালয়ে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে মুখ ঢেকে বেরিয়ে যান

রাজধানীর ইডেন কলেজ ক্যাম্পাসে দুই পক্ষের মধ্যে দিনভর উত্তেজনা ও মারামারির পর কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় সংসদ। একই সঙ্গে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে ১৬ নেতাকর্মীকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে সেই তালিকায় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও তাদের কোন অনুসারীর নাম না থাকায় নতুন করে বিতর্কের সৃৃষ্টি হয়েছে। বহিষ্কৃত এবং ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দাবি, ‘স্থায়ী
বহিষ্কারের এই প্রক্রিয়ায় সংগঠনের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ ছাড়া একপক্ষীয় বিচারের কারণেই শুধু বিক্ষোভকারীদের বহিষ্কার করা হয়েছে।’
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে ১৭ ধারার (খ) উপধারায় বলা হয়েছে, ছাত্রলীগের যে কোন শাখা উপযুক্ত কারণ দর্শিয়ে কোন অভিযুক্ত সদস্যের সদস্যপদ তিন মাসের জন্য স্থগিত করতে পারবেন। (গ) উপধারায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ অভিযুক্ত সদস্যদের বিষয়ে নিজস্ব তদন্ত পরিচালনা করে প্রয়োজনে আরও কঠোর শাস্তি অথবা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিতে পারবেন। বহিষ্কৃত নেত্রীরা বলছেন, ‘সুষ্ঠু তদন্ত ও অভিযুক্তদের কোন বক্তব্য না নিয়েই তাদেরকে শাস্তি দেয়া হয়েছে।’
রবিবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ১৬ জনকে স্থায়ী বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এর মধ্যে ১০ জন সহসভাপতি, একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ও চারজন কর্মী। তবে দুই পক্ষই সংঘর্ষে জড়ালেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও তাদের কোন অনুসারীকে বহিষ্কার করা হয়নি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে সংগঠনের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপে জড়িত থাকায় তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
স্থায়ী বহিষ্কার হওয়া নেত্রীরা হলেন- ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি সোনালি আক্তার, সুস্মিতা বাড়ৈ, জেবুন্নাহার শিলা, কল্পনা বেগম, জান্নাতুল ফেরদৌস, আফরোজা রশ্মি, মারজানা ঊর্মি, সানজিদা পারভীন চৌধুরী, এস এম মিলি ও সাদিয়া জাহান সাথী। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফাতেমা খানম বিন্তি, সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার বৈশাখি এবং কর্মী রাফিয়া নীলা, নোশিন শার্মিলী, জান্নাতুল লিমা ও সূচনা আক্তার।
বহিষ্কারের বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা একটা তদন্ত কমিটি করেছিলাম, তারা তাতে আস্থা রাখতে পারছে না। তাই আমরা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ একটি বডি মিলে এই ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত করেছি। আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ঘটনায় আরও তদন্ত চলবে।’
বহিষ্কারের প্রতিক্রিয়ায় সোমবার আবারও সংবাদ সম্মেলন করেন বহিষ্কৃতরা। সেখানে স্থায়ী বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত একপক্ষীয় হয়েছে উল্লেখ করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা। বহিষ্কৃত সহসভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈ বলেন, ‘রবিবার রাতের আঁধারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, এটির প্রতিবাদেই আজকে আমাদের এই সংবাদ সম্মেলন। প্রাথমিক তদন্তে বহিষ্কারে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। আজকে আমাদের কোন অন্যায়ের কারণে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে? আমাদের অপরাধ হলো- আমরা নির্যাতিত সহযোদ্ধার পাশে দাঁড়িয়েছি। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে এত বিস্তর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের কেন বহিষ্কার করা হলো না?’
বহিষ্কারের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি অভিযোগ করে সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার বৈশাখি বলেন, ‘বিভিন্ন ইউনিটে কোন সমস্যা হলে সেই সমস্যা সমাধানের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়। অথচ, আমাদের ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। তাহলে কি তারা এই অন্যায়ের ক্ষেত্রে সহমত পোষণ করছে?’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সংবাদ সম্মেলনে আমরা ২৫ জন ছিলাম। তাহলে কেন শুধু ১২ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে? বাকিদের কেন করা হয়নি? এ থেকে বোঝা যায়, আমরা প্রতিহিংসার শিকার।’ আরেক সহসভাপতি সোনালি আক্তার বলেন, ‘যে চারজন কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে, এই নামে ইডেন কলেজে কোন কর্মীই নেই। এটা কিভাবে আসল আমাদের বুঝে আসে না।’
এক ঘণ্টায় শেষ হলো অনশন ॥ ইডেন কলেজ ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন শেষে ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আমরণ অনশন শুরু করেন বহিষ্কৃতরা। তবে এক ঘণ্টা পার না হতেই কার্যালয় ত্যাগ করেন তারা। এ সময় সামিয়া আখতার বৈশাখি বলেন, ‘আমরা অনশন করতে এসেছিলাম। এখন চলে যাচ্ছি। অনশন করব না। আমাদের ওপর অনেক চাপ। আমরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাই না।’
এর আগে কার্যালয়ে প্রবেশ মুখেই বাধার শিকার হয়েছিলেন তারা। প্রতিবাদ করলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়ার পর আবারও গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বহিষ্কৃত নেত্রীরা আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের একটি কক্ষে অবস্থান নেন। সেখানে যান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য আবদুল আওয়াল শামীম এবং উপ-দফতর সম্পাদক সায়েম খান। এ সময় আবদুল আওয়াল শামীম তাদেরকে কার্যালয় থেকে বের হয়ে যেতে বলেন।
প্রসঙ্গত, গত ২২ সেপ্টম্বর গণমাধ্যমে রিভা ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে ‘চাঁদাবাজি ও সিট বাণিজ্য’ করার অভিযোগ তোলেন কলেজ কমিটির সহসভাপতি জান্নাতুল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গত শনিবার রাতে তাদের অনুসারীরা জান্নাতকে একটি কক্ষে আটকে রেখে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার পর পরই ছাত্রলীগের একাংশ বিক্ষোভ মিছিল করলে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রিভা ও রাজিয়াকে বহিষ্কার না করলে কমিটির ২৫ জন নেত্রী একযোগে পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দেন। দিনভর উত্তেজনা শেষে রিভা ও রাজিয়ার সংবাদ সম্মেলন চলমান অবস্থাতেই দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি শুরু হয়। এতে অন্তত দশজন আহত হন।
চলতি বছর ১৩ মে ঢাকার তামান্না জেসমিন রিভাকে সভাপতি ও রজিয়া সুলতানাকে সাধারণ সম্পাদক করে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের ৪৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটি ঘোষণার পরেই সংঘর্ষ হয় দুই পক্ষের মধ্যে। এর দুইদিন পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিতে গিয়ে আবারও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সে সময় রিভা ও তার অনুসারীরা দুইজনকে মারধর করে বলে অভিযোগ ওঠে। কমিটির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই নানা বিতর্কে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন তিনি। সিট বাণিজ্য, সংগঠনের কর্মসূচীতে না যাওয়ায় মারধর, দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনসহ অসংখ্য অভিযোগ আসে তার বিরুদ্ধে। তবে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।