
প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে শিল্পকলার নাট্যশালায় মিতা যুবরাজ উৎসবের উদ্বোধন করেন অতিথিরা
তারা দুজনেই হেঁটেছেন শিল্পের পথে। স্বদেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল তাদের শিল্পচর্চার অঙ্গীকার। অসাম্প্রদায়িক স্বদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণ ছিল শিল্পীদ্বয়ের শিল্পচর্চার অহংকার। শিল্পচর্চায় একজন বেছে নিয়েছিলেন অভিনয়শিল্পকে। অপরজন কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন সঙ্গীতের সাতটি স্বর। অঙ্গীকারাবদ্ধ সেই শিল্পিত পথরেখাতেই একসময় তারা হয়েছিলেন পরস্পরের জীবনসঙ্গী। এই দুজন হলেন মঞ্চনাটকের যুবরাজখ্যাত খালেদ খান এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক। শিল্পের আলোকরেখাতেই স্মরণ করা হলো এই শিল্পী-যুগলকে। বাউলের গানের সুরে নিবেদিত হলো শ্রদ্ধাঞ্জলি। কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে জানানো হলো ভালবাসা। উৎসবে বর্ণিল করেছে নাটকের মঞ্চায়ন। সেই সঙ্গে ছিল তাদের সংস্পর্শে আসা প্রিয়জনদের স্মৃতিচারণ। বিশিষ্টজনরা বললেন দেশের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় দুই বরেণ্য শিল্পীর কীর্তির কথা। শুক্রবার বিকেল থেকে রাত অবধি চলেছে শিল্পকলা একাডেমি আঙিনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে মিতা যুবরাজ উৎসব। বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান অসাম্প্রদায়িকতা ও মিতা-যুবরাজ স্লোগানে উৎসবটির আয়োজন করে যুবরাজ সংঘ।
বিকেল থেকে শুরু হওয়া উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন সন্ধ্যায়। একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে শিল্পী দম্পতির প্রতিকৃতির সামনে প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে উৎসব উদ্বোধন করেন বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার। এসময় তার সঙ্গী ছিলেন বাকি অতিথিরা। তাদের মধ্যে ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, অভিনয়শিল্পী সারা যাকের, নাট্যকার ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী। আলোচনা পর্বের আগে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন মিতা হকের গড়া সঙ্গীতদল সুরতীর্থের শিল্পীরা।
উদ্বোধনী বক্তব্যে ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, মিতা হক ও খালেদ খান দুজনেই আমার পছন্দের মানুষ ছিল। বিশেষ করে যুবরাজের অভিনয়ের পাশাপাশি তার গাওয়া গান আমার ভাল লাগত।
মফিদুল হক বলেন, অকালে ঝরে পড়া দুটি ফুল খালেদ খান ও মিতা হক। শিউলি ফুলের মতো তারা স্বল্প সময়ে ঝরে গেলেও রেখে গেছেন সৌরভ। এই শিল্পী দম্পতি শিল্পের সাধনায় নিজেদের জীবনকে উজাড় করে দিয়েছেন। সেই শিল্প সাধনায় তারা সোচ্চার ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। হৃদয়ের গহীনে ধারণ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাদের মধ্যে মিতা হক রবীন্দ্রসঙ্গীতচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। পরিবেশনার মাধ্যমে গানের বাণী বা বক্তব্যের দৃঢ়তাকে তিনি পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন শ্রোতার মননে। দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে তিনি সঙ্গীতের আশ্রয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অভয় বাণী ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এই উৎসবের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মাঝে এই শিল্পী-যুগলের প্রতিবাদী চেতনাটি ছড়িয়ে যাবে। তারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই শিল্পী দম্পতির অভয়মন্ত্রকে ধারণ করবে।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, নিঃসন্দেহে একজন উঁচুমাপের অভিনেতা ছিলেন খালেদ খান। নাট্যমঞ্চের সেরা অভিনেতাদের মধ্যে সে ছিল একজন। আপন অভিনয়শৈলীর গুণে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য সে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। অন্যদিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে মিতা হক শুধু বাংলাদেশেই নয় ভারতের গন্ডি ছাপিয়ে সকল বাংলা ভাষাভাষীর কাছে সমাদৃত হয়েছেন।
পরিবেশনার মাঝে তার সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও দেশের প্রতি যে নিবেদন তা নতুন প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয়। এ দম্পতি নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। তাই নতুনের আবাহনের এ পথ দেখাবে উৎসবে খালেদ খান মিতা হক।
এছাড়া উৎসবের স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য দেন বুলবুল ইসলাম ও লাইসা আহমদ লিসা।
অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী বলেন, প্রকৃত অর্থে মঞ্চের যুবরাজ ছিলেন খালেদ খান। আশির দশকে ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ ও ‘অচলায়তন’ নাটকে তার যে অভিনয়, তা আজও আমার হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। এই শক্তিমান অভিনেতা অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাস্তবায়নে আমৃত্যু কাজ করেছেন। একইভাবে মিতা হকও শিল্পী হিসেবে অসাম্প্রদায়িক দেশ ও রাষ্ট্র গড়ার কারিগর ছিলেন। এ ধরনের শিল্পীর মৃত্যু হয় না, দেহাবসান হয়।
আয়োজনটি প্রসঙ্গে মিতা হকের মেয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ফারহিন খান জয়িতা বলেন, আমি মনে করি একজন প্রকৃত শিল্পীর তার দেশ ও সমাজের প্রতি আদর্শিক দায়বদ্ধতা থাকে। সৌভাগ্যক্রমে এই দম্পতির সন্তান হওয়ায় আমি দেখেছি তাদের সেই গুণটি। শিল্পচর্চার পাশাপাশি তাঁরা সমাজ নিয়ে ভেবেছেন, দেশ নিয়ে ভেবেছেন, সংস্কৃতি নিয়ে ভেবেছেন। পাশাপাশি তারা নিজস্ব গন্ডি এবং গন্ডির বাইরে তাদের সেই দর্শনকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সংস্কৃতি যতবার আক্রান্ত হয়েছে তারা তাদের জায়গা থেকে কখনও নীরবে, কখনও সরবে কাজ করে গেছেন।
বিকেল থেকেই শুরু হওয়া উৎসবে একাডেমির নিশাত চত্বরের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পরিবেশিত হয় বাউল গান। পরিবেশনা উপস্থাপন করেন আরিফ বাউল ও তার দল। তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ফকির লালন সাঁইসহ বাংলার শেকড়সন্ধানী লোকগান। এরপর পরিবেশনা পর্বটি চলে যায় নাট্যশালা মিলনায়তনে। এ পর্বের শুরুতে নাট্যশালার বারান্দায় ‘আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায়’ গানের সুরে আহ্বান নৃত্য পরিবেশন করে র্যাচেল প্রিয়াঙ্কা ও তার দল। এছাড়া মিলনাতনে নৃত্য পরিবেশন করে সামিনা হোসাইন প্রেমা এবং কস্তুরী মুখার্জী ও তার দল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আসাদুজ্জামান নূর সুবর্ণা মুস্তাফা ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। সুর ও কথনের আশ্রয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন ভারতের বিখ্যাত শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য। মঞ্চস্থ হয় মাসুম রেজা রচিত ও মোস্তাফিজ শাহীন নির্দেশিত নাটক ‘আবছায়ায় যুবরাজ’।
প্রযোজনাটিতে অভিনয় করেন ইন্তেখাব দিনার, রওনক হাসান, ত্রপা মজুমদার ও জ্যোতি সিনহা। এছাড়া উৎসব উপলক্ষে খালেদ খান ও মিতা হকের বর্ণিল সাংস্কৃতিক জীবনের স্মৃতিময় নানা আলোকচিত্রের দেখা জাতীয় নাট্যশালার লবিতে।