
বাবু ইসলাম ॥ গ্রামের মানুষ, শহরের মানুষ এক নামে চেনেন তাকে। এলাকার লোকজন তাকে ভালবাসেন, সম্মান করেন। তার স্কুলের শিক্ষার্থী কিংবা স্বামীর রাজনৈতিক সহকর্মীদের দুঃখ-দুর্দশায় নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে গেছেন, সহযোগিতা করেছেন। কঠিন দুঃসময়েও তিনি হার মানেননি। তিনি তার নিজের মনন, মেধা দিয়ে শহরের গৌরী আরবান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়কে গড়ে তুলেছেন একটি আদর্শ বিদ্যাপীঠে। তিনি ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন প্রেরণাদায়ী নারী, একজন প্রগতিশীল, মুক্ত চিন্তার মানুষ। কথাবার্তায় ছিলেন সহজ- সরল। হিংসা-বিদ্বেষ কটু কথা তিনি কখনও পছন্দ করেননি। মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্য এই মহীয়সী নারীকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়েছে। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা একাধারে কথা সাহিত্যিক ও শিক্ষক। সিরাজগঞ্জের খ্যাতনামা সৈয়দ পরিবারের সন্তান এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব আনোয়ার হোসেন রতুর স্ত্রী হিসেবে তার মনে কোন অহঙ্কার ছিল না। তবে তিনি সর্বদাই গর্ববোধ করেছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে। সর্বোপরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি সান্নিধ্য পাবার গৌরবে। এই মহীয়সী নারীর নাম সৈয়দা ইসাবেলা। এই মহীয়সী নারী মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।
শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাথীদের সঙ্গে মমতাময়ী মায়ের মতো সম্পর্ক ছিল সৈয়দা ইসাবেলার। শহরের বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গৌরী আরবান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়েন প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার মেধা, মনন দিয়ে তিনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তার মা-বাবা দুজনেই ছিলেন শিক্ষক। নারী সমাজকে জাগ্রত করার প্রয়াস নিয়ে বালিকা বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন ১৯৭৩ সালে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রায় ৩০ বছর দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান ২০০২ সালে। এই ৩০ বছরে রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা ঘাত-প্রতিঘাত উতরিয়ে তার মেধা, মনন দিয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী গড়ে তুলেছেন। তাদের অনেকেই এখন দেশ-বিদেশে নিজের যোগ্যতার খ্যাতি ছড়িয়েছেন। তার মৃত্যুর পর গৌরী আরবান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে তাকে স্মরণে রাখার জন্য বহুতল বিশিষ্ট একটি ভবনের নামকরণ করা হয়েছে সৈয়দা ইসাবেলা একাডেমিক ভবন। তার নামে প্রতিষ্ঠিত ইসাবেলা ফাউন্ডেশন মানব হিতৈষী ও পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করছে।
নারী সমাজের প্রগতির দিশারী রত্নগর্ভা মা সৈয়দা ইসাবেলা জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছেন। কখনও ভেঙ্গে পড়েননি। হাসিমাখা মুখখানা কখনও মলিন দেখেছে এমন মানুুষ মেলা ভার। তিনি কখনও বিমর্ষ হননি বা মলিনতা তাকে স্পর্শ করেনি। তার স্বামী ছিলেন ততকালীন সিরাজগঞ্জ মহুকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। জেলখানা ছিল তার স্বামীর সেকেন্ড হোম। এ কারণে পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাকে ভাবিয়ে তুলেছে স্বামী-সন্তানদের জীবন চলা নিয়ে। কিন্তু দৃঢ়চেতা কঠিন মনোবল নিয়ে তিনি এগিয়ে গেছেন। কখনও মাথা নত করেননি। পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র সন্তানকে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
ছোটবেলা থেকেই লেখার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এই মহীয়সী নারী উদার মনের এবং প্রগতিশীল। উপমহাদেশের মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূত ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ভাতিজি। তিনি শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। তিনি ২২টিরও বেশি সাহিত্য রচনা করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বই অমানিশার জোনাকি, পুরুষোত্তম, পাখির পালক ও রাজপুত্ররা, যাদুর প্রদীপ, মালাচির কুটির, নেংটি ইঁদুর ও বুড়ো বিড়াল, বুগলি ও সোনা পাখী।
সিরাজগঞ্জের খ্যাতনামা সৈয়দ পরিবারের সন্তান সৈয়দা ইসাবেলা ছোট বেলা থেকেই ছিলেন অসাধারণ মেধার অধিকারী। কিন্তু জীবন কাটিয়েছেন সাদাসিদেভাবে। নারী সমাজের প্রগতির দিশারী রতœগর্ভা মা সৈয়দা ইসাবেলা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তার স্বামী আনোয়ার হোসেন রতুর সঙ্গে ভারতে যান। তিনি নারী জাগরণে এবং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য নাম।
১৯৪২ সালের ২৪ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের সৈয়দ পরিবারে সৈয়দ মোহাম্মদ ইসহাক ও আছিরন নেছা খন্দকার দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। মা-বাবা দুজনেই ছিলেন শিক্ষক। বড় চাচা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী উপমহাদেশে মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূত, কবি ও সাহিত্যিক। ২০১৩ সালের ১১ জানুয়ারি মহীয়সী নারী সৈয়দা ইসাবেলা মৃত্যুবরণ করেন।
সৈয়দা ইসাবেলা সিরাজগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৫৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শহরের আমলাপাড়া নিবাসী আনোয়ার হোসেন রতুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন এই মহীয়সী নারী।